
কান্না-হাসির কথা
বাইরে ‘সুখ’। বাইরেই অসুখ। করোনা এফেক্ট। বাধ্যতামূলক ঘরে অন্তরিন। অমান্য মানে বিপদকে নেমন্তন্ন করে আনা। তাই সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। ঘরে সেই স্বস্তি। ঘরেই অস্বস্তি। তবে উপায়? চিন্তাকে চিন্তামণির ওপর ছেড়ে মন হালকা রাখাই সবচেয়ে ভাল উপায়। এই ‘জরুরি অবস্থা’র দিনে আপনাদের জন্যেই ‘দ্য ওয়াল’ এনেছে হাসির লেখা ‘বারোয়ারি নকশা’। পড়ুন, মন ভাল রাখুন।
তন্ময় চট্টোপাধ্যায়
আমাদের স্কুলের বন্ধু বিলাসকে অনেকে বলত কান্নাবিলাস। তার কান্না বা কান্নার বিলাসিতা যাই বলুন না কেন, তার একটা প্রভাব পড়েছিল আমাদের জীবনে।
বিলাসের রোগ ধরা পড়েছিল অনেক ছোট বয়সে। সেবারে অঙ্ক পরীক্ষায় এসেছিল, ‘রামবাবুর অকালমৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র ছেলে তাঁর জমানো টাকা ৫% সরল সুদের হারে…’।
সরল সুদের অঙ্ক। তা ‘ক’-এর দাগের সেই অঙ্কের সুদ আর কষা হল না। বিলাসের দু’চোখ দিয়ে কান্না ঝরতে লাগল। চোখ লাল করমচার মতো। কারণ আর কিছু না— রামবাবুর অকালমৃত্যু। এক ঘণ্টা কেটে গেল তবু রামবাবুর মৃত্যু শোক কাটিয়ে উঠতে পারল না বিলাস।
বিলাস ইংরেজিতে ভাল। হেডস্যারের প্রিয় ছাত্র। সব শুনে হেডস্যার গুম হয়ে গেলেন। অঙ্কের স্যার ফণীবাবুকে ডেকে বললেন, “অঙ্কের ভাষা এত করুণ না করলেও পারতেন। সুদের হিসেবের তো আর হেরফের হত না।”
ফণীবাবু তো থ। একটু রেগেও গেলেন। পরিচিত মহলে বললেন, “অঙ্কে দুঃখ দেখানো যাবে না, এ আবার কেমন কথা? দুঃখ কি সাহিত্যের মনোপলি না কি?”
কথাটা হয়তো হেডস্যারের কানেও গেল। তিনি ফতোয়া জারি করলেন, প্রশ্নপত্র এবার থেকে ‘মৃত্যুহীন’ করতে হবে। প্রশ্ন শক্ত হয় হোক কিন্তু ট্র্যাজেডি দেখানো যাবে না।
ইতিহাসের স্যার একটু প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ধোপে টিকল না।
বিলাস ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারির ছেলে। তার জন্য স্কুলের পরিবেশ বদলে গেল।
ইংরেজি সিলেবাসে ‘সেলফিস জায়েন্ট’। শেষ দৃশ্যে তার মৃত্যু। বিলাস ভাসাবেই। হেডস্যার স্ট্র্যাটেজি বদল করলেন। তাঁর বাকচাতুরিতে গল্পের শেষ দৃশ্যের এমন বর্ণনা দিলেন যাতে মনে হল প্যারাডাইসে গিয়ে বোধহয় নবজন্ম হল জায়েন্টের। বিলাস তার ফ্লাডগেট ওপেন করার সুযোগ আর পেল না।

বিলাসের জন্য আমরা স্কুলে এক নন-ভায়োলেন্ট পরিবেশ পেয়ে গেলাম। স্কুলের বাইরে অবশ্য ছেলেপুলেরা ইচ্ছে করে মরার গল্প তুলে ধরত। বিলাস অঝোরে ঝরাত। সেই নিয়ে অন্যদের চলত হাসিঠাট্টা।
বয়েস একটু বাড়তেই অবশ্য গল্প গেল ঘুরে। প্রেমে পড়ল বিলাস। বেশ জমকালো প্রেম। আর তার পরেই কোনও এক ম্যাজিকে কেটে গেল তার কান্না রোগ।
কবিরা প্রেমকে কেন ‘মৃত্যুহীন’ বলেন তা কিছুটা অনুমান করেছিলাম এ গল্প শুনে। প্রেমের মৃত্যু হলে বিলাস ও পথ ভিজিয়ে ফেলত।
স্কুল পার হয়ে গেলাম কলেজে। তখন সবে ফার্স্ট ইয়ার। আবিষ্কার করলাম আর এক কান্না রোগীকে। এর সমস্যা অবশ্য মৃত্যু নয়।
রোগ ধরা পড়ল এক সরস্বতী পুজোর দিনে। চারপাশে খুশি খুশি পরিবেশ। বক্স বাজছে। হোস্টেলের ছাদে গিয়ে দেখি এককোণে বসে আছে বিশু। চোখে একটা দুঃখী ভাব।
“কী ব্যাপার রে বিশু, এখানে বসে?”
“ভেতরটা কেমন যেন হচ্ছে ভাই।”
“শরীর খারাপ লাগছে না কি? দুপুরে খিচুড়ি খেয়েছিস? অ্যাসিডিটি?”
“অ্যাসিড-গ্যাস না রে। গানগুলো যত শুনছি, ভেতরটা কেমন যেন উথালপাথাল করছে।”
গানে কান দিলাম। বক্সে বাজছে আধুনিক গায়কের গাওয়া পুরনো দিনের গান। মনে মনে ভাবছি, মনখারাপ কাটানোর কী নিদান দেওয়া যায়।
বিশু শুরু করল, “আসলে কী জানিস, ক’দিন ধরেই এমনটা হচ্ছে। ‘মায়াবী’ শব্দ শুনলেই নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারি না।”
ছড়িয়ে গেল খবর। ইন্টারেস্টিং কেস। জড়ো হল আরও কয়েকজন। বিশুকে ঘিরে ধরল সকলে। “মায়াবী শব্দ কী জিনিস ভাই?”
সকলের চোখ বিশুর চোখে। বিশু আমতা আমতা করে বলল, “কী বলি বল তো, যেমন ধর এই ‘খেলাঘর’, ‘নীড় ভাঙা ঢেউ’, ‘পারাপার’, ‘যমুনা’, ‘তুমি নেই’, ‘বিরহ’, ‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি’ — এইসব শব্দ। শুনলেই বুকে কে যেন হাতুড়ি পেটায়।
কারও এক হালকা হাসি পিচিক করে বেরিয়ে এল। ভেসে এল প্রশ্ন, “ছোট থেকেই এই অবস্থা না কি ভাই?”
“না, এই ক’দিন ধরেই হচ্ছে। শুধু গান নয়, কবিতা পড়লেও ওই এক অবস্থা। ভেতরে কী একটা কষ্ট। চোখে জলও চলে আসছে মাঝে মাঝে।”
আমাদের মধ্যে সমীর ছিল বিশেষ বোদ্ধা। হাত দেখতেও জানত। নিজেকে বলত ‘জ্যান্ত কিরো’। সে বিশুর হাতখানা তুলে নিল নিজের হাতে। তারপর লেন্স নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ। হাত দেখা হলে বিশুর চোখে চোখ মেলাল সে। ঘরে পিন-পতন নিস্তব্ধতা। হাতের রেখার পরে হয়তো চলছে কপাল-পাঠ। চারপাশে কৌতূহল।
সমীর বলল, “শোন বিশু, লক্ষণ ভাল নয়। সবই হল ঝড়ের পূর্বলক্ষণ। ঝড় কিন্তু উঠবেই ভাই। আর একেবারে লন্ডভন্ড করে দেবে তোকে। হয় ভগবৎ প্রেমে পাগল হবি, নয়তো মানব প্রেমে মাতাল। একটা কথা হলফ করে বলছি, তুই আর স্বাভাবিক থাকতে পারবি না ভাই।”
পাশ থেকে কে একজন বলল, “ আহা, ভয় না দেখিয়ে ভাল কোনও রাস্তা তো দেখা।”
সমীর বলল, “রাস্তা একটা আছে, আর সেটা হল ভুলেও কলেজের লেডিস হোস্টেলের রাস্তা যেন মাড়াস না।”
আড়ালে সমীর বলেছিল, “দিব্যদৃষ্টিতে দেখছি, ভালবাসার বারান্দায় বাঁধা এক ছাগল। তবে কার বারান্দায় বাঁধা আছে তা এখনও দেখতে পাচ্ছি না।”
দার্শনিক সমীর। নিশ্চয়ই তার তৃতীয় নয়ন ছিল। কিছুদিন পরে প্রকাশ পেল আসল কথা। লেডিস হোস্টেলের মিঠু নাকি বিশুর মন জুড়ে বসে। কিছু দূরেই লেডিস হোস্টেল। হোস্টেলের ছাদে বসে ‘এ কূল ও কূল’-এর রহস্য বোঝা গেল এতদিনে। ভালবাসা জমে যেতে সেরে গেল বিশুর উথালপাথাল। সেরে গেল কান্নারোগ।
কান্না-হাসির এই গল্প বলেছিলাম জীবনরসিক এক সুদর্শন মাঝবয়েসিকে। জীবনে সব ছিল। তবু সংসারে পা রাখেননি। কেন রাখেননি কেউ জানে না। একা থাকেন। সঙ্গী সিগারেট আর ভাল বই। গল্প শুনে বললেন, “বুঝলে ভায়া, প্রেম হল এক শোকসাগরের মতো। সে সাগরে ডুব দিলে ছোটখাটো শোক উবে যায়। দু’জনেরই আসলে বিষে বিষে বিষক্ষয় হয়ে গেছে। তাই মুছে গেছে কান্না।”
একটু সাহসী হয়েই বললাম, “প্রেম তো বোধহয় করেননি কোনওদিন। শোকসাগরের স্বাদ পেলেন কী করে?”
সেই দাদাটি হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, “পৃথিবীর সব সুন্দরীর বিয়ে হয়ে গেল। তাই প্রেম আর করা হল কই?”
আলো-আঁধারিতে দেখলাম, দাদাটির চোখের কোণ চিক চিক করে উঠল। না জেনে দুঃখ দিলাম কিনা কে জানে। নয়তো হাসির গপ্পো কেন কান্না টেনে আনে?
চিত্রকর: রাজ রায়
পড়ুন আগের পর্বগুলি…