
পত্রঘাতক
বাইরে ‘সুখ’। বাইরেই অসুখ। করোনা এফেক্ট। বাধ্যতামূলক ঘরে অন্তরিন। অমান্য মানে বিপদকে নেমন্তন্ন করে আনা। তাই সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল। ঘরে সেই স্বস্তি। ঘরেই অস্বস্তি। তবে উপায়? চিন্তাকে চিন্তামণির ওপর ছেড়ে মন হালকা রাখাই সবচেয়ে ভাল উপায়। এই ‘জরুরি অবস্থা’র দিনে আপনাদের জন্যেই ‘দ্য ওয়াল’ এনেছে হাসির লেখা ‘বারোয়ারি নকশা’। পড়ুন, মন ভাল রাখুন।
তন্ময় চট্টোপাধ্যায়
বছর তিরিশ আগের কথা। সিঁড়িভাঙা অঙ্কের দিন সবে তখন শেষ হয়েছে আমাদের। ঠোঁটের ওপর গোঁফের রেখা। খুব ঝামেলায় ফেলেছে অঙ্কের বাঁদর। বেজায় জ্বালাচ্ছে। উঠছে, পড়ছে। ‘পাটী’-র পাশে পাটি পেড়ে এসে বসেছে বীজগণিত। বিজ্ঞানও ভেঙে দু’ভাগ। এই ভাঙাভাঙির কালে এক ফুরফুরে বিকেলে পটাই এসে সূচনা করল এক লম্বা গল্পের। বলল, “জানিস তো, মিলিদি প্রেম করছে অজয়দার সঙ্গে।”
“গুল দিচ্ছিস না তো?”
প্রমাণস্বরূপ সে যা দেখাল তাতে তো আমাদের চোখ উঠল কপালে। দেখলাম, পটাইয়ের হাতে অজয়দাকে লেখা মিলিদির প্রেমপত্র।
“তার মানে তুই এখন… ?” বেশ কয়েকজনের একসঙ্গে প্রশ্ন।
পটাই বলল, “হ্যাঁ ভাই, আমি এখন পত্রবাহক।” বলেই গলা নামিয়ে আমাদেরকে সাবধানবাণী, “তোরা কিন্তু চুপচাপ থাকিস ভাই, দেখিস যেন জানাজানি না হয়।”
বেঁটেখাটো পটাই। মুখে ভালমানুষি ভাব। পড়াশোনায় অষ্টরম্ভা। তবে প্রেম-ভালবাসায় ভীষণ অনুরাগ।
পাড়ার ছেলে অজয়দা। কিছুদিন আগে মুম্বই থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ফিরেছে। মিলিদিও এ পাড়ার। দেখতে-শুনতে বেশ। তাদের প্রেম। যোগসূত্র পটাই। তাই দুই বাড়িতেই তার অবারিত দ্বার।
নতুন কাজে সে যে বেশ ব্যস্ত তা বোঝা যায়। বিকেলে খুব একটা দেখা মেলে না পটাইয়ের। একদিন আড্ডার আসরে হঠাৎ হাজিরা দিতেই কে যেন বলল, “আসুন ঘটকমশাই।”
সঙ্গে সঙ্গে পটাই ডিফেন্স মোডে। “এটা কিন্তু তোদের ভুল। ঘটকালি কিন্তু আমি শুরু করিনি ভাই, সে করেছে অন্য কেউ!”
“কে করেছে? কে ভাই?” চারপাশ থেকে কয়েকজনের প্রশ্ন।
“তাহলে খুলেই বলি ব্যাপারটা।” বলে শুরু করল পটাই, “রেনিং ক্যাটস অ্যান্ড ডগ্স, শুনেছিস তো? এ গল্পেও ঠিক তাই। প্রথমে ক্যাট এল, তারপর ডগ, তারপর অঝোরে ভালবাসার বৃষ্টি।”
“মানে?”
“মানে আর কী? শুরু হয়েছিল মিলিদির বেড়াল খ্যান্তমণির হাত ধরে। খ্যান্তর যেমন স্বভাব, নতুন মানুষ দেখলেই সে একটু ঢলে পড়ে। মুম্বই-ফেরত হ্যান্ডসাম অজয়দাকে দেখে মিত্তিরবাড়িতে তার আনাগোনা হুট করেই বেড়ে গেল। ক’দিনেই খুব ভাব জমিয়ে ফেলল অজয়দার সঙ্গে। খুশি হয়ে অজয়দা একদিন সবুজ রঙের এক ইম্পোর্টেড স্কার্ফ বেঁধে দিয়েছিল খ্যান্তর গলায়। আর সেই দিয়েই গল্পের শুরু।”
“তারপর?”
“তারপর কী আবার, মিলিদি তো আহ্লাদে আটখানা। তার বেড়ালকে কে এত ভালবাসে? খোঁজ খোঁজ করে খোঁজ মিলল। মিলিদির মনে ধরল অজয়দাকে। তারপর থেকে ভোরের পথে দু’জনের নিত্য দেখা। মিলিদির মর্নিং কলেজ আর অজয়দার মর্নিং ওয়াক। তবে তখনও অবশ্য বাক্যালাপ নেই। দু’জনকে আরও কাছে এনে দিল মিলিদির কুকুর।”
“বেড়ালের পর কুকুর?”
“হ্যাঁ রে ভাই, তখন দিনকয়েক মিলিদিকে কলেজের পথে এগিয়ে দিচ্ছিল ওর কাকা আর ওদের কালো অ্যালসেশিয়ান। এদিকে অজয়দার আবার কুকুর-ভীতি। কুকুর নাকি অজয়দাকে দেখলেই চেন ছিঁড়তে চাইত। তাই দেখাশোনা তো বন্ধ হবার যোগাড়। এই সময় অজয়দা বুদ্ধি করে ঘুড়িতে দু’কলম লিখে সেই ঘুড়ি নামিয়ে দিলে মিলিদির ছাদে।”
“কী লিখেছিল বল না ভাই।”
“ছোট্ট একটা ছড়া— ভোরের হিমেল হাওয়া, আমাদের আসা-যাওয়া/ আজ যেন কেটে গেল সুর/ স্বপ্ন বিফলে গেল, সুখসাধ গিলে খেল/ তোমাদের সাধের কুকুর।”
“এই সব কি চিঠি পড়ে জেনেছিস না কি?”
“তা ছাড়া আর জানব কোত্থেকে? শুরুর কথা মিলিদি ফাঁস করেছে তার চিঠিতে। তবে দেখিস, খবরদার, এসব কথা যেন পাঁচকান না হয়।”
মনে মনে ভাবতাম, ওঃ পটাই কী জিনিস! তখন ক্লাসে চৌবাচ্চার অঙ্ক চলছে আমাদের। জল বড় নল বেয়ে ঢোকে, ফুটো দিয়ে বের হয়। মনে হত, পটাই যেন সেই জ্যান্ত চৌবাচ্চা। তবে তার ইনপুট-আউটপুট সমান।
অসাধারণ বাঁশি বাজাত অজয়দা। মাঝেমাঝেই রাতের বেলায় বেজে উঠত তার বাঁশি। আমরা কিন্তু আগেভাগে টাইমটেবল জানতে পারতাম। পটাই খবর দিত, “আজ রাতে বিশুদা বাঁশিতে বেহাগ শোনাবে।”
“বেহাগ কেন ভাই?”
“মিলিদির কাছ থেকে অনুরোধ এসেছে। কী লিখেছে শোন, কতদিন তোমার বাঁশিতে বেহাগ শুনিনি। আজ ঠিক রাত ন’টায় ছাদের ঘরে বসে বেহাগ ধরবে কিন্তু। পশ্চিমের জানলায় বসে আজ বেহাগ শুনব। ভুলে গেলে চিঠি বন্ধ হবে, মনে রেখো।”
আমরা অপেক্ষায় থাকতাম। চাঁদের নরম আলো। তার মধ্যে বেহাগের সুর। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। বাঁশির সুরে কী অদ্ভুত মাদকতা। টের পেতাম নৈসর্গিক প্রেম। আমাদের বন্ধু সুধন্য সেই বয়সেই খুব রোম্যান্টিক। সে বলত, “ভাই, আমি যদি মেয়ে হতাম আর চাঁদনি রাতে এমন বাঁশি যদি কেউ বাজাত আমার জন্য, তবে সে রাতেই বাড়ি ছেড়ে নির্ঘাত পালিয়ে যেতাম তার সঙ্গে।”
অজয়দার বাঁশি শোনার আবদার মাঝেমাঝেই করত মিলিদি। হুকুম তামিলও হত। বন্ধুরা বলত, “বিয়ের পরে মানুষটার ভাগ্যে কিন্তু দুঃখ আছে। গোবেচারা পত্নীনিষ্ঠ হয়ে যাবে, দেখিস।”
পটাই বলত, “এখনই কি কম নাকি, সেদিন কী লিখেছে জানিস?”
“কী, বল না ভাই।”
“লিখেছে, তোমার ভালবাসার বটগাছে বাঁধা আমি এক ছাগল, মাঝেমাঝে দর্শনের যে বটপাতা ফেলে দাও তাই চিবোই আর ব্যা ব্যা করি।”
“বলিস কী রে! ইস, একেবারে ছাগল!”
পটাই বলত, “অন্যভাবে নিস না যেন, অজয়দাকে আদর করে মিলিদি ‘অজা’ বলে ডাকে কিনা, তাই ছাগল।”
হাসতে হাসতে একসময় থেমে যেতাম আমরা। আমাদের বন্ধু সুজন পটাইকে বলত, “তবে তোর ভাগ্যে দুঃখ আছে পটাই। তুই যেভাবে ছড়াচ্ছিস তাতে অজয়দার কানে এ কথা উঠবেই। আর তখন তোর প্যাঁদানি বাঁধা। পেঁদিয়ে একেবারে খগেন করবে তোকে।”
পটাইয়ের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যেত, চোখ পিটপিট করতে করতে বলত, “ওই জন্যই তো তোদের কাছে অনুরোধ করি, দেখিস কথাগুলো যেন পাঁচকান না হয়।”
পাঁচকান নয়, পঁচিশ কান হয়েছিল। তবে তাতে অবশ্য সমস্যা হয়নি। নিয়ম মেনে অজয়দা-মিলিদির প্রেম হাঁটা দিল বিয়ের পথে। ঠিক হয়ে গেল বিয়ের তারিখ। জানা গেল, বিয়ের পর অফিসের কাজে প্যারিস যাবে অজয়দা। সঙ্গে মিলিদিও।
সেই সুখের দিনে একদিন পটাই এল মুখগোমড়া করে।
“কী ব্যাপার পিওন সাহেব, কাজে তো ইতি পড়ল এবার। তা পিওন-বিদায়ী কী মিলবে বল?”
পটাই বলল, “শেষচিঠিতে কিন্তু একটা দুঃসংবাদ আছে ভাই।”
“কীসের আবার দুঃসংবাদ রে?”
“বিয়েটা হয়তো হবে, তবে মিলিদির দুঃখ কেউ কোনওদিন বুঝবে না ভাই। চিরকাল মনে মনে গুমরে মরবে মেয়েটা।”
“সে আবার কী রে? এতদিনের ভালবাসার শেষে বিয়ে হচ্ছে, কীসের আবার দুঃখ?”
“মিলিদির আসল সমস্যা হল ওই পদবি। অজয়দারা যে মিত্র।”
“কেন, মিত্রতে কী দোষ?”
পটাই বলল, “তাহলে মিলিদির জবানিতেই শোন। মিলিদি লিখেছে, বিদেশে গিয়ে তুমি তো দিব্বি অজয় মিটার হবে কিন্তু আমার কথা একবারও ভেবে দেখেছ? ৫ ফুট ১০ হাইট নিয়ে আমাকে হতে হবে মিলি মিটার! ওঃ ভগবান, শেষমেশ এই ছিল আমার কপালে!”
মিলি মিটারে আমাদের দুঃখ “হো হো” করে ঝরে পড়ল।
পটাই গম্ভীর হয়ে বলল, “দেখিস কাউকে যেন এসব আবার বলিস না ভাই।”
অজয়দা-মিলিদির বিয়ে। ধুমধাম হইচই। বিয়ের পরেই বিদেশযাত্রা। মিলিদির চোখে জল। দেখলাম পটাইও কাঁদছে। কে যেন পাশ থেকে ফিসফিস করে বলল, “কে কাঁদছে দ্যাখ না ভাই, পত্রবাহক না পত্রপাঠক?”
মনে মনে বললুম পত্রঘাতক বললেও মন্দ হয় না।
চিত্রকর: রাজ রায়