
উত্তম দত্ত
সব ভালোবাসারই দুঃখ থাকে। ভাষাকে ভালোবাসার দুঃখও কম নয়। ভাষার জন্য বুকের রক্ত ঝরানোর ইতিহাস রচিত হয়েছে আমাদের ঘরেই পাশেই, ঘরের কাছে। তাও একবার নয়, তিন তিনবার। বাংলাদেশ, অসম আর পুরুলিয়ার মানুষ প্রমাণ করে দিয়েছে, প্রিয় মানুষের মতো প্রিয় ভাষাকেও নিজের প্রাণের বিনিময়ে রক্ষা করতে হয়।

২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের যেসব মানুষ উর্দু আগ্রাসনের হাত থেকে প্রিয় মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছিলেন, ১৯৬১ সালের ১৯ মে অসমের বরাক উপত্যকায় অসমিয়া ভাষার আগ্রাসন থেকে মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য যে ১১ জন বাঙালি অসম রাইফেলসের পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন কিংবা ১৯১২ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে মানভূমের যে বাঙালিরা হিন্দি-আগ্রাসনের হাত থেকে বাংলাভাষাকে রক্ষা করার জন্য দীর্ঘতম সংগ্রাম করেছিলেন তাঁদের রক্তের রঙ ও গোত্র ছিল অভিন্ন।
কিন্তু প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি এলেই মনে হয় বাংলাভাষা যেন আজ জনকদুহিতা সীতার মতো অরক্ষিত। অনেক রক্তের বিনিময়ে তাকে রক্ষা করা হয়েছে, কিন্তু আমরা তার প্রাপ্য সম্মান ও সুরক্ষা দিতে পারিনি। তার চরিত্র ও সততায় অবিরত সংশয় প্রকাশ করে আমরা কখনও তাকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করেছি, আবার কখনও অবহেলার বনবাসে নির্বাসনে পাঠিয়েছি। একটি বাংলা বাক্যে দুটি ইংরেজি তিনটি হিন্দি শব্দ ব্যবহার করে নির্লজ্জের মতো শ্লাঘা বোধ করছি। ঘরের শিশুদের ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলে পড়তে পাঠিয়ে গৌরব বোধ করছি। তাদের যত্ন করে বাংলাভাষাটা শেখাচ্ছি না। সরকারি কাজেও বাংলাভাষা আজ কোণঠাসা। এই বঙ্গের ‘শপিংমল’, ‘রেস্তোরাঁ’ আর বিমানবন্দরগুলিতেও ইংরেজি ও হিন্দিভাষার আশ্চর্য দাপটকে আমরা অবলীলায় সমর্থন করছি। লিখতে গিয়ে বাংলা শব্দের বানান ভুল করে তিলমাত্র লজ্জিত হচ্ছি না।

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় একদা আক্ষেপ করে বলেছিলেন : যে ভাষার ভাত দেবার মুরোদ নেই সেই ভাষা মানুষ পড়বে কেন?
অথচ বাংলাভাষার এই দুরবস্থার জন্য বাঙালি জাতিই অনেকখানি দায়ী। আমাদের ক্রমবর্ধমান উদাসীনতা, হীনন্মন্যতা আর অসচেতনতাই এই প্রিয় মাতৃভাষাটির দুর্দশাকে প্রতিনিয়ত শোচনীয় করে তুলছে।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১ ফেব্রুয়ারি এলেই মনে হয় : হে বাংলাভাষা, তুমি শুধু ২১শে ফেব্রুয়ারি। মনে হয় সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউরের বিদেহী আত্মা আমাদের ক্ষমা করবে না। মনে হয় বরাক উপত্যকার ভাষা-শহীদ কানাইলাল, চণ্ডীচরণ, হিতেশ, সত্যেন্দ্র, কুমুদ, সুনীল, তরণী, শচীন্দ্র, বীরেন্দ্র, সুকোমল এবং কমলা ভট্টাচার্যের দীর্ঘশ্বাস আমাদের ঘিরে ফেলেছে। আমাদের প্রায়শ্চিত্তের দিন সমাগত।
ইউনেস্কোর উদ্যোগে, ১৮৮ টি দেশের সমর্থনে ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষাদিবস পালিত হচ্ছে।
পৃথিবীর বহু ভাষাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরও ৪০ শতাংশ ভাষা ক্রম-বিলুপ্তির পথে। এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে ৭১১১ টি ভাষায় মানুষ কথা বলে। আজকের দিনটি সেই সমস্ত ভাষারই আনন্দের দিন। বাংলাদেশের ভাষা-শহীদদের রক্তের বার্তা ও ভালোবাসা আজকের দিনে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বিশ্বে। পৃথিবীর এই মিষ্টতম ভাষার জন্য দুই দেশে যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের আত্মত্যাগ বিফলে যেতে পারে না। বাংলাদেশ, অসম, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ছাড়াও ভারত ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাভাষার প্রচলন রয়েছে। আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওন বাংলাকে তাদের অন্যতম প্রধান সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি জানিয়েছে। আমেরিকা, য়ুরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষার পঠনপাঠন ও গবেষণা চলছে। পড়ানো হচ্ছে রামপ্রসাদের পদাবলি, বৈষ্ণবপদ, বাউলগান, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ…।
প্রায় ২৮ কোটি মানুষ এই ভাষায় কম-বেশি কথা বলেন। মনে পড়ছে কবি সুবোধ সরকার লিখেছিলেন : ‘ সব বাঙালিরা বাংলা বললে ঘটে যাবে বাজিমাত!’
আমরা যেদিন অনুভব করব, ভাঙা ভাঙা ইংরেজি ও হিন্দির চাইতে পরিশুদ্ধ বাংলাভাষায় অনেক গভীরভাবে একজন বাঙালির হৃদয়ের কথা অন্য একজন বাঙালির মর্মে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব সেদিনই আমাদের ভাষাশহীদ দিবস মেঘমুক্ত আকাশের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। যে ভাষায় বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, জীবনানন্দ দাশ হিরের অক্ষরমালা রচনা করে গেছেন, সেই ভাষা সম্পর্কে যেদিন আমাদের যাবতীয় হীনন্মন্যতা দূর হবে সেদিনই বিশ্বব্যাপী আলো ছড়াবে ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন ৩৬৫ দিনই হয়ে উঠবে আমাদের হিরণ্ময় মাতৃভাষা দিবস।
বাংলাভাষায় আরও বিজ্ঞান-চর্চা হোক, এই ভাষা অচিরেই হয়ে উঠুক উচ্চশিক্ষার সুযোগ্য মাধ্যম। এই বঙ্গের সরকারি কাজে বাংলাভাষার ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পাক। প্রবাসে বা ভিনরাজ্যে দুজন বাঙালির দেখা হলে তারা সানন্দে ও নির্দ্বিধায় বাংলাভাষায় কথা বলুক। ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার সঙ্গে বাঙালি জাতি নিজের ভাষাকেও সমধিক গুরুত্ব দিক। আঞ্চলিক বাংলাভাষাগুলিকে সাহিত্যে আরও গুরুত্ব দেওয়া হোক। দোকানপাট হোটেল রেস্তোরাঁর নামের শীর্ষদেশে থাকুক বাংলা। বাংলা শব্দের বানান বিষয়ে প্রতিনিয়ত সতর্ক থাকুক এদেশের মানুষ। বাংলা সাহিত্যকে অনুবাদের মাধ্যমে আরও বেশি করে সমগ্র বিশ্বের মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিক যোগ্য ও সংবেদনশীল অনুবাদকেরা। সেই অনূদিত সাহিত্যের আস্বাদ লাভ করে কোনও কোনও ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ নিশ্চয়ই মূল বাংলাভাষায় রচনাটি পাঠ করতে আগ্রহী হবেন। সেটাও আমাদের ভাষার জন্য মঙ্গলজনক।
নিজের মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোয় কোনও গৌরব নেই, বরং তাতে আত্মার অবমাননা আছে। তেমনি নিজের মাতৃভাষাকে অবজ্ঞার অন্ধকারে নির্বাসন দিয়ে শিকড়হীন জীবন-যাপনেও কোনও গৌরব নেই। প্রত্যেক মাতৃভাষাই এক অনন্য ঐতিহ্যের স্মারক ও বাহক। রক্তের মধ্যে বিষ ঢুকে পড়লে মানুষের সেই পবিত্র ভাষাবোধ দেউলিয়া হয়ে যায়। মানুষ তখন নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির কবর নিজেই রচনা করে।