
বেবী সাউ
“গণিকালয়, মীনবাজার তৈরি করে কারা ?
প্রতিযুগেই ইন্দ্র কেন উর্বশীর অধীশ্বর হন ?”
( আম্রপালী, মল্লিকা সেনগুপ্ত)
মল্লিকা সেনগুপ্ত নামক একজন কবি যে ছিলেন বাংলা সাহিত্যে, তা বাংলা সাহিত্যের সৌভাগ্য। যে ধারার প্রচলন করেছিলেন কবিতা সিংহ তাঁর কবিতায়, ভাবনায়, তাকেই আরও ক্ষুরধার এবং তীব্র করে তোলার কাব্যভাষা মল্লিকা সেনগুপ্ত–র এক নিজস্বী বলা চলে। চল্লিশ চাঁদের আয়ু’(১৯৮৩), ‘সোহাগ শর্বরী’(১৯৮৫), ‘আমি সিন্ধুর মেয়ে’(১৯৮৮), হাঘরে ও দেবদাসী’(১৯৯১), ‘অর্ধেক পৃথিবী’(১৯৯৩), মেয়েদের অ আ ক খ(১৯৯৭), কথামানবী(১৯৯৭), পুরুষকে লেখা চিঠি(২০০২) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে তিনি বারংবার আঘাত করেছেন আমাদের সমাজের পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে। কিন্তু, স্পষ্ট ভাবে বলার কথা যেটি, তা হল, এই সামাজিক–রাজনৈতিক লক্ষ তাঁর কবিতার মেরুদণ্ড তৈরি করলেও, তা কখনও স্লোগান হয়ে যায়নি। উচ্চকিত ভাষায় কথা বলেনি। বরং কবিতায় একপ্রকার ‘কথা’ (ডায়ালগ) তৈরি করার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। কবিতায় এই পাঠকের সঙ্গে বা সমাজের সঙ্গে ডায়ালগের বিষয়টি মল্লিকা সেনগুপ্ত আট–এর দশকে এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেলেন। যদিও তিনি একা এক কাব্য–অভিপ্রায়ের পথে হাঁটেননি। কাব্য–অভিপ্রায়ের এই ‘সন্দর্ভ’ প্রবণতাকে আট–এর দশকের আরেক কবি জয়দেব বসুও করে তুলেছিলেন তাঁর কবিতার মূল অক্ষ। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমরা দুজনকেই হারিয়েছি।
মেধা ও মননের এক যৌথ-সঙ্গীত ছিল মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতার বৈশিষ্ট্য। সবথেকে বড় কথা, কবিতাগুলির মধ্যে অসংখ্য গলি, রাজপথ, পুরাণ, দর্শন এবং সমাজতত্ত্বও লুকিয়ে রয়েছে। দলিত শ্রেণির, অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের জীবনধারার সঙ্গে তথাকথিত প্রবহমান প্রগতিশীল ভারতবর্ষের যে চলমান দ্বন্দ্ব, তাকেও তিনি তুলে ধরেছেন কবিতায়। যেমন, ‘কন্যাশ্লোক’ কবিতায় তিনি লেখেন–
মেয়েটির নাম দুর্গা সোরেন বটেক
মায়ের ছিলনা অক্ষর জ্ঞান ছটেক।
সর্বশিক্ষা অভিযানে পেয়ে বৃত্তি
দুর্গা হয়েছে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি।
সাঁওতালি গান, ইংরেজি ভাষা বাঁ হাতে
কম্প্যুটারে শিখেছে ইমেল পাঠাতে।
অঙ্কের স্যার ভুল হলে যোগ বিয়োগে
গায়ে হাত দেয় পড়া শেখানোর সুযোগে।
দুর্গা জানেনা কোনটা যৌন লাঞ্ছনা
স্যারটা নোংরা বটেক!–কথাটা মানছ না?
শেষে একদিন স্যারের নোংরা হাতটা
মোচড়ে দিয়েছে দুর্গা, মেরেছে ঝাপটা!
ওরে অর্ধেক আকাশে মাটিতে শ্যাওলা
আকাশে উড়বে, হবে কল্পনা চাওলা।
যদি না বিমান ভেঙে পড়ে তার দুদ্দাড়
মহাকাশচারী হবেই বটেক দুর্গা।
‘আপনি বলুন মার্কস’ কবিতায় আবার প্রতিধ্বনিত হয় এক জটিল সমাজতাত্ত্বিক– অর্থনৈতিক ভাবনা, যার মূল বিষয়ই হল কীভাবে মেয়েদের শ্রমকে ব্যবহার করেছে এই সমাজ, এমনকী সেই সমাজ যখন প্রগতিশীল এক স্বপ্ন দেখছে, সেখানেও মেয়েদের শ্রম ব্যবহৃত।
… হাড়ভাঙ্গা খাটুনির শেষে রাত হলে
ছেলেকে পিট্টি দিয়ে বসে বসে কাঁদে
সেও কি শ্রমিক নয় !
আপনি বলুন মার্কস, শ্রম কাকে বলে !
গৃহশ্রমে মজুরী হয়না বলে মেয়েগুলি শুধু
ঘরে বসে বিপ্লবীর ভাত রেঁধে দেবে
আর কমরেড শুধু যার
হাতে কাস্তে হাতুড়ি !
আপনাকে মানায় না এই অবিচার
কখনো বিপ্লব হলে
পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য হবে
শ্রেণীহীন রাষ্ট্রহীন আলোপৃথিবীর
সেই দেশে
আপনি বলুন মার্কস,
মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী
হবে ?”
মেয়েদের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবার কথা এবং তার আর্তি উঠে আসে মল্লিকা সেনগুপ্তর কবিতায়। আমরা যদি লিঙ্গবৈষম্যের রাজনীতির প্রেক্ষিত থেকে মল্লিকা সেনগুপ্তর কবিতা এবং গদ্যের দিকে তাকাই, তাহলে বলতেই হবে, বাংলায় এই বিষয় নিয়ে তাঁর মতো করে এমন সমৃদ্ধ কাজ কেউ করেননি। যে কাজ শুধুমাত্র কিছু মন্তব্য বা কিছু প্রতিবাদ ছুঁড়ে দেওয়া নয়, বরং, যে কাজ সমাজতত্ত্বের ভিত খনন করে তার অন্তরাত্মা খুঁড়ে দেখার। পাঠককে এমন ভাবে তার নিজেরই সামনে দাঁড় করানোর কাজ খুব একটা কোনও ভাষাতেই পাওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘সীতায়ন’ এবং ‘ স্ত্রী লিঙ্গ নির্মাণ’ ভাবে মনে হয়, তাঁর উপন্যাস এবং প্রবন্ধ তাঁর কবিতার পাশাপাশি না পড়লে আমরা তাঁর কাজের সামগ্রিকতাকে ছুঁতে পারব না। কারণ তিনি এলোমেলোভাবে ব্যক্তিগত অনুভূতিমালার রোমান্টিক ও হাফ–রোমান্টিক আত্মচরিতচর্বণের মধ্যে নিজের লেখাকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁর প্রতিটি কবিতা এক গভীর সমাজবীক্ষণের পরিচয়। ‘মধুর কবিতার বিরুদ্ধে’ নামক একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, “শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এসে বাংলা কবিতা যেন এক প্রশ্ন-চিহ্নের সামনে দাঁড়িয়েছে, যেন শিবির বিভাজনের উত্তাপ ভেসে আসছে হাওয়ায়– মধুর কবিতা না রক্তমাংসে নোনা কবিতা- আসলে এভাবে কোনও বিভাজন হয় না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেই ঠিক করে নিতে হবে বাংলা কবিতাকে তারা গুড়ের নাগরি বানাবে, না রক্তমাংসে গড়া প্রাণের সন্তান।”
আমরা যদি তাঁর কাব্য-অভিপ্রায়কে বুঝতে পারি, তাহলে তাঁর আজীবনের কাজকে মর্যাদা দিতে পারব বলে মনে হয়। আধুনিকতা ছাড়িয়ে যে আধুনিকোত্তর সময়ে আমরা পাড়ি দিয়েছি, সেখানে শুধুমাত্র আত্মঘোষণা ও আত্ম-অনুভূতির চর্বিতচর্বণকে কবিতার লক্ষ হিসেবে না ভেবে আমাদের উচিত কবিতাকে একটি সন্দর্ভ হিসেবেই দেখা। আসলে কবিতার মধ্যে দিয়ে আমরা সেই সত্যকেই খুঁজে বেড়াচ্ছি, যে সত্যগুলির সামনে দাঁড়াতে ভয় পাই। একজন কবির কাজ, পাঠককে এই অস্বস্তির মুখোমুখি দাঁড় করানো। মল্লিকা সেনগুপ্ত স্বস্তিতে থাকতে দেননি পাঠককে। তাঁর কবিতা পড়ে বই বন্ধ করে শপিং করতে বেরিয়ে পড়া যায় না। তাঁর কবিতা পড়ার পরে মনের মধ্যে একপ্রকার ঝড় চলতে থাকে। ডিলানের ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড গানটির মতোই হাজারো প্রশ্নের বীজ মনের মধ্যে গুনগুন করে ওঠে। ইতিহাসের নারীচরিত্রগুলি যেমন তাঁর কবিতার মধ্যে কথা বলে ওঠে। মনে হয় সীতা, দ্রৌপদী সকলে এতকাল মুখ বুজে আছেন। তাঁরা কথা বলে উঠছেন। তাহলে আমি কেন বলব না? প্রথম কাব্যসংকলন ‘চল্লিশ চাঁদের আয়ু’ থেকেই যে মল্লিকা সেনগুপ্ত পাঠককে এক অন্যরকম কবিতার স্বাদ দিতে শুরু করেন, তা ‘আমি সিন্ধুর মেয়ে’-তে এসে সম্পূর্ণ অবয়ব পায়। তার পর তো আজীবন তিনি একের পর এক অজস্র ধাপ অতিক্রম করতে করতে হাঁটা দেন অন্য এক কবিতার ভুবনে। বাংলা কবিতার বনস্পতির কাছেও সম্ভবত মল্লিকা সেনগুপ্ত এক অস্বস্তির নাম। কারণ, তিনি এমন সব প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেছেন,যার উত্তর দিতে গেলে সমাজকেই খোল নলচে বদলানো দরকার। তখন হয়তো তাঁর কবিতার মতো করেই বলতে হবে—
“দূরের চাষিকে শালপাতা মুড়ে খবর পাঠাও
আনো কেরোসিন, যদি দরকার হয় আগুন জ্বালাব”
(তেভাগার ডায়েরি)