
হিন্দোল ভট্টাচার্য
‘সবাই সাপোর্ট করছে বলে তুইও আর্জেন্তিনাকে সাপোর্ট করছিস। কেন? আর্জেন্তিনা কি তোর দেশ?’
‘ না, সত্যি কথা বলছি, আমি আর্জেন্তিনার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। কিন্তু স্রেফ একটা লোক এই দেশের জন্য খেলে গেছেন বলেই আমি সাপোর্ট করছি। তিনি দিয়েগো মারাদোনা।
‘ দিয়েগো মারাদোনা! একটা অসহ্য লোক। ড্রাগ অ্যাডিক্ট, বিশৃঙ্খল, দুশ্চরিত্র, কোকেনের নেশা, আবার সে নাকি বিপ্লবের সমর্থক। আসলে তো একটা চূড়ান্ত অসভ্য অ্যানার্কিস্ট।’
‘ তো?’
‘ তো মানে? একটা লোক স্রেফ হাত দিয়ে ঠেলে বলল হ্যান্ড অফ গড। মানে, মিথ্যেটাকে একটা নাম দিয়ে দিল। চূড়ান্ত অসৎ না হলে কেউ এমন করে না। একটা অসৎ, দুর্বিনীত , দুশ্চরিত্র লোককে এতটা উপাসনা করার দরকারটা কী বল তো। স্রেফ ফুটবলার ছাড়া আর তো কেউ নয়। স্পোর্টসম্যানদের মধ্যে এমন লোক হয়তো পাওয়া যায় না। এমন ভাব করে যেন চে। আসলে তো পাবলো এস্কোবার।’
‘ আমার মনে হয় সমস্ত কিছুকে এমন সহজ একরৈখিক ভাবে না দেখলেও চলবে। মারাদোনা শুধু একজন ফুটবলার নন।’
তাহলে তিনি কে? কেন ছোটবেলায় মারাদোনাকে দেখলেই বুকের মধ্যে ধুকপুক শুরু হয়ে যেত। তাঁর পায়ে বল পড়লেই মনে হত পৃথিবীতে আর কেউ নেই, আর কিছু নেই। মারাদোনাকে কখনওই আমার মনে হয়নি তিনি দক্ষিণ গোলার্ধের একটি দেশের নাগরিক, আবার ইতালিতেই বেশিরভাগ সময় কাটান। তাঁর জীবন কেমন, ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ কেমন, কতজন তাঁর শয্যাসঙ্গিনী, ড্রাগ নেন কি না, পাগল কিনা, এসব কিছুই জানার আগ্রহ তখন হয়নি। তখন আমার বয়স খুবই কম। হাফপ্যান্টের গণ্ডিও পেরোইনি। কিন্তু মারাদোনা মানেই জানতাম, আমার জীবনের এক রূপকথা, যাকে সত্যি হতেই হবে। যেন তিনি আমাদের সকলের হয়ে বিশাল পাথর পিঠে নিয়ে একবার পাহাড়ে উঠছেন, একবার নামছেন। না, তিনি কখনওই শুধু আর্জেন্তিনা বা আর্হেন্তিনা বা আর্খেন্তিনার মানুষ হতে পারেন না। তিনি ভারতের, তিনি কলকাতার, তিনি বাংলাদেশের, মালয়েশিয়ার, ঘানার, সেনেগালের, নিকারাগুয়ার, কিউবার, লেবাননের, প্যালেস্তাইনের, ইরাকের, সার্বিয়ার, ক্রোয়েশিয়ার, নাইজেরিয়ার, ইথিওপিয়ার, বলিভিয়ার, সোমালিয়ার, আফগানিস্তানের, আজারবাইজানের, মাদাগাস্কারের, দিল্লির, বোগোটোর, চিলির, ভেনেজুয়েলার এবং সারা পৃথিবীর। তিনি আমার ঘরের দুষ্টু লোক, যার দুষ্টুমি আমি সহ্য করব, কারণ তিনিই আমাকে স্বপ্ন দেখতে শেখান। কী আছে তাঁর? একটা নীল সাদা জার্সি, একটা বুট, একটা বল আর পাগলামি ছাড়া? সামনে যতজনই আসুক না কেন, মারাদোনা থামবেন না, কারণ তিনি জানেন, থামতে নেই। এই পৃথিবীতে তোমায় মেরে ফেলার জন্যই সকলে উন্মুখ হয়ে আছে। তোমায় ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়ার জন্যই সকলের চক্রব্যূহ। কিন্তু তুমি তো আসলে অশ্বত্থামা। তুমি সেই ব্যূহে ঢুকবেই, তাকে ভাঙবেই। মরেও যাবে কখনও। আবার তুমি উঠবে। খুব বিষণ্ণ এক হেমন্তের রাতে, ঘুমের ভিতর দেখতে পাব তোমার সেই অবিস্মরণীয় পাস থেকেই গোল করছে ক্যনিজিয়া। দেখব, ঔপনিবেশিক ইংল্যান্ডের ইউরোপীয় ডিফেন্সের প্রাচীর ভেঙে তুমিই এগিয়ে যাচ্ছ দুরূহতম কোণে আর তার পর সমস্ত ঔপনিবেশিক গর্ব ভেঙে যাচ্ছে শোষিত মানুষের দ্রোহের স্কিলে। তুমি জানো, যুদ্ধে এবং ভালোবাসায় নীতি বলে কিছু নেই। বিশেষ করে সেই সব ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে, যদি তুমি জালে বল ঢোকাও অনৈতিক ভাবেও, তাহলেও তা অনৈতিক নয়, কারণ এই গোল আসলে প্রতিশোধ। না, আমিও তোমার মতো খেলাকে আলাদা করতে পারি না সামগ্রিক দ্রোহ থেকে। আমিও আলাদা করতে পারি না খেলাকে আমার অন্তরের রোমান্টিকতা থেকে। আমি জানি, আমি যখন তোমার খেলা দেখতাম, তখন আমার কোনও দেশ নেই। এক মুহূর্তে তুমি আমাকে নিয়ে যেতে জন লেননের সেই বিশ্বে, যেখানে সীমানা নেই কোনও, কাঁটাতার নেই কোনও। তোমার জীবন আমাকে টানত। এই অ্যানার্কি একজন প্রতিভাবান মানুষের। এই বিশাল শোষণের বিশ্বে যদি একজন মানুষকে একলা দাঁড়াতে হয়, তবে তাকে নিজের নিয়মেই দাঁড়াতে হবে। ইবসেনের নাটকের সংলাপটা বারবার মনে পড়ে তোমার খেলা দেখতে দেখতে, ‘ দ্য স্ট্রঙ্গেস্ট ম্যান ইজ হি, হু স্ট্যান্ডস অ্যালোন’।
তুমি শুধুমাত্র একজন ফুটবলার যে নও, তা বুঝি। তুমি হলে ফুটবলের চে গ্যেভারা, ফুটবলের র্যাঁবো, ফুটবলের ফাইনম্যান, ফুটবলের কেরুয়াক, ফুটবলের ভ্যান গঘ, ফুটবলের জন লেনন। তোমায় কোনও ছাঁচে ফেলতে পারছি না আমি। এ জন্য আমার কোনও দুঃখ নেই। সকলকে ছাঁচে ফেলে দেওয়ার এই আধুনিক বাসনা দিয়ে প্রকৃত শিল্পীদের কখনও বন্ধু হওয়া যায়নি। আমি তোমাকে চোখের সামনে দেখিনি। দেখতেও চাই না। চে গ্যেভারাকেও আমি চোখের সামনে দেখিনি। ফিদেলকে, মার্কেজকে, বোর্হেসকে, লোরকাকে, মায়াকভস্কিকে, রুজেভিচকে, পাসোলিনিকে, সুবিয়েলাকে, তার্কোভস্কিকে, গোদারকেও আমি চোখের সামনে দেখিনি। তাতে কী হল! আমি তো জীবনানন্দ দাশকেও চোখের সামনে দেখিনি। আমি দেখিনি, ফলে তাঁরা মৃত নন। দান্তে কি জীবিত না মৃত? জয়েস বা অস্কার ওয়াইল্ড? তাঁরা কি মারা গেছেন? না কি রোজ বেঁচে ওঠেন?
আমার দুঃখের দিন মারাদোনা, তুমিই থাকবে। তুমিই আসলে আমার একটা ক্ষুদ্র দেশ। যেমন একটা বৃহৎ দেশ আমার রয়েছে, যার নাম বাংলাভাষা। আরেকটা বড় দেশের সীমানাও খুলে যায় আমার মনের ভিতর। তার নাম স্বপ্ন।
আমার প্রিয় পরিচালক সুবিয়েলার সেই দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ গড –এর প্রথম সিকোয়েন্সের মতো আমিও একদিন সমুদ্রের মধ্য দিয়ে উঠে আসবে সেই সৈকতে, যেখানে তোমরা হয়তো রোদ পোহাচ্ছ এখন।
ততদিন তোমারই খেলা দেখি। আর মনে মনে বলি, মারাদোনা এক বিপ্লবেরও নাম।
অনেক আবেগ এখন নীল সাদা জার্সি হয়ে ছুটে যাচ্ছে।
আমার তুমি, অরক্ষিত কাব্যগ্রন্থে নিজেকে মারাদোনা ভেবে একটি কবিতা লিখেছিলাম। তা অবশ্য কেউ পড়েনি।
সেটাই বরং তুলে দিই। আমার তর্পণ।
“ নেমেছি ফুটবল খেলতে সোনালি ছুরির মতো ভোরে
সঙ্গী নেই
গোলপোস্ট ফাঁকা…
আর কেউ পাহারা দিতে পারছে না আমায়
এমনকি তুমিও ভাবছ না
হা হা হা আ হা হা
সব দায়দায়িত্বের ছুটি
(খেলা, ৪/৪/০১, তুমি, অরক্ষিত)
ফুটবল ঈশ্বরহীন। ফুটবল বিপ্লবহীন আজ।
(লেখক কবি, অনুবাদক ও গদ্যকার। পেশায় বিজ্ঞাপনকর্মী। লিখেছেন পনেরোটি কাব্যগ্রন্থ, দুটি গল্প সংকলন ও একটি উপন্যাস। পেয়েছেন বীরেন্দ্র পুরস্কার (২০০৯) ও অনিতা- সুনীল বসু পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমি (২০১৮)।)