
হিন্দোল ভট্টাচার্য

জাতীয়সঙ্গীত এমনভাবে মৃত্যুভয় দেখিয়ে গাওয়ানো হবে, এ কথা জানলে রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত গান লেখা ও সুর দেওয়াও ছেড়ে দিতেন। অন্তত লিখলে বা গাইলেও তা রাষ্ট্রকে দিতেন না। বা, নাইট উপাধি ত্যাগের সময় যেভাবে বাছা বাছা বিশুদ্ধ শব্দ ব্যবহার করে ইংরেজদের তুলোধনা করেছিলেন, তার চেয়েও আরও ঘৃণা বর্ষিত হত আজকের ভারত নামক রাষ্ট্রের প্রতি।
তো, রবীন্দ্রনাথকে তো বহুবার অপমান করা হয়েছে, আমরাই করেছি। কিন্তু তাতে এমন সংস্কৃতি যায় যায় বলে রব তো ওঠেনি। কয়েকদিন আগে এই দেশে পুলিশ-মিলিটারি সহযোগে হিন্দু দাঙ্গাবাজেরা দাঙ্গা করল সংগঠিতভাবে, কেউ সংস্কৃতি ধসে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করছেন না। বাংলা সিনেমায় রবীন্দ্রনাথের গানের নামে যে ক্যাওড়াকীর্তন চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে, সে-সব শুনেও মানুষের কান্না পাচ্ছে না। সংস্কৃতি ধসে যাচ্ছে না। আমরা নির্দ্বিধায় এই বাংলাতে বসেও সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলছি। হিন্দু রাষ্ট্র এবং হিন্দু ফ্যাসিস্ট ভাবনা বলছি। এই রাজ্যে বসে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, লোকহিত বা হিন্দু মুসলমান বা সভ্যতার সংকট। আজ হল কী?
অবশ্যই আমি সমর্থন করি না, রুচিহীন বলে মনে করি ‘বিপ বিপ চাঁদ উঠেছিল গগনে’–র মতো গান, কিন্তু সে সব নিয়ে আলোচনা করে সেই সব গান এবং গায়কদের বেশি গুরুত্ব দিতে চাই না। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের গান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বা তাঁর প্রবন্ধ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাঁর প্রতিষ্ঠানের চেয়ে। ঠিক যে চারটি মেয়ের পিঠে কিছু অপশব্দ বসন্ত উৎসবের প্রাক্কালে দেখে মানুষ বলছেন, রবীন্দ্রনাথের গায়ে এত অন্ধকার ছিটকে এল কেন? বা বলছেন, এ আমাদের লজ্জা। আমি তাঁদের সঙ্গে একমত।
কিন্তু অবক্ষয়ের বা নিম্নরুচির এটি একটি খুব সামান্য অংশ। তাঁরা পিঠে বা বুকে ‘ফাক ইউ’ লিখে ঘুরছেন, কিন্তু কেউ তো জনগণমন গাওয়াচ্ছেন না মৃত্যুভয় দেখিয়ে। তাঁদের কার্যকলাপে তো কিছু মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন না। তাঁরা তাঁদের মতো করে আছেন। নিম্নরুচির মানুষ। কিন্তু কীই বা করা যাবে? আর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতির কী সম্পর্ক, তা আমি কোনওদিন বুঝিনি। খালি বসন্ত উৎসবে একটা শান্তিনিকেতনীয় আবহ ফুটে ওঠে বলে? দোল খেলা হয় বলে? রবীন্দ্রনৃত্য হয় বলে? বাংলার সংস্কৃতি কি এইগুলির ওপরেই নির্ভরশীল? এই সব ছেলেমেয়েদের একজনও বলতে পারবেন রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের কবিতা বা যে কোনও গানের প্রথম দু’লাইন বাদ দিয়ে বাকি লাইনগুলি? পড়েছেন রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ বা তাঁর নাটক? অচলায়তন বা তাসের দেশ বা রক্তকরবী? আমরাও কি বলতে পারব?
সমস্যা হল ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশনের। টয়গান ছুড়ে পায়রামহলে চঞ্চলতা সৃষ্টি করার স্যাডিজম, ম্যাসোচিজম। ধর্ষ-মর্ষকাম। রাজনৈতিক দর্শন এবং ভাবনার অভাব। কিন্তু এরাই তো আর বাঙালি নয়, বা দেশ নয়। এরা চায় ওই চঞ্চলতা সৃষ্টি করে টিআরপি বাড়াতে। একটু ভাইরাল হতে। এছাড়া এদের কোনও বড় মাপের উদ্দেশ্য আছে কি? মনে তো হয় না। এরা প্রবলভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক বা নৈরাজ্যবাদী, তেমনটাও তো মনে হচ্ছে না। খুবই স্থূল, খুব-ই ছোট তাদের লক্ষ্য। বা হয়তো লক্ষ্যও নেই। রবীন্দ্রভারতী বাংলার সংস্কৃতির বা রবীন্দ্রনাথের ধ্বজা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল না কোনওদিন, আর বাংলার সামগ্রিক রুচিনির্মাণে তাদের অবদান আছে বলে মনেও হয় না।
কিন্তু অবক্ষয়ের কথা যদি বলেন, এরা হল একটা ফল, দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে অবক্ষয় চলছে। এই সময়টাই অবক্ষয় এবং অধোগতির সময়। এরা ভাইরাল হয়ে চোখে পড়তে চায়, আমরাও ভাইরাল করে এদের মধ্যে থাকা একজিবিশনিজমকে চরিতার্থ করতে সাহায্য করছি। অথচ রবীন্দ্রনাথকে কলুষিত করা হচ্ছে এই যুক্তিতে যদি কথা বলি, তা হলে তো আমাদের আগে কথা বলা উচিত মৃত্যুভয় দেখিয়ে জাতীয়সঙ্গীত গাওয়ানো নিয়ে। তা কি করছি?
আমরাই কি ভাল করে রবীন্দ্রনাথ পড়ছি? ভাবার চেষ্টা করছি, তিনি কী বলে গেছেন? আমরাও যে যে বিষয়ে কথা বলা দরকার, সে বিষয়ে কথা না বলে, এমন অনেক বিষয়ে অত্যধিক ‘গেল গেল’ রবে কাতর হয়ে উঠছি না তো? রবীন্দ্রনাথ-দান্তে-গ্যয়টে-জীবনানন্দ-লালন-রামপ্রসাদ— এঁদের কলুষিত এখন কে করবে বলতে পারেন? আর বাঙালির সংস্কৃতি নিয়ে কোনওদিন-ই উচ্চ কোনও ধারণা পোষণ করার কোনও কারণ ঘটেনি। চিরকাল-ই একদল আছেন, যাঁরা আসলে খুব ওপর-ওপর বাঁচেন। এতেই হয়তো তাঁদের আনন্দ। রাগ করার কিছু নেই। ঘৃণা করারও না। সম্ভবত উপেক্ষা করার প্রয়োজন এখন। অথচ আমরাই উপেক্ষা না করে তাদের একটা সামাজিক ফেনোমেনা করে তুলছি।
ভাবুন তো, যারা এভাবে প্রদর্শনকারী, তারা অসম্মান কি নিজেদেরকেই করল না? রবীন্দ্রনাথকে অসম্মান করার ক্ষমতা বা যোগ্যতা আমাদের কারও আছে কি?