
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এতদিনে বোঝালেন, ভোটে গুন্ডামি কাদের প্রয়োজন হয়!
শঙ্খদীপ দাস
প্রতিটা নির্বাচনই কিছু না কিছু শিক্ষা দেয়। কেউ সেই শিক্ষা নিয়ে ফের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কেউ এমন শিক্ষা পায় যে আর উঠে দাঁড়াতেই পারে না, তবে বোধোদয় নিশ্চয়ই হয়।
সোমবার নন্দীগ্রামের ঠাকুরচকে সভা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠা ঠা রোদ। তবে এলোমেলো হাওয়া ছিল। দেখা গেল, দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াই ও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শুরুর দিকেই অভিযোগ করছেন, বিজেপি বহিরাগত গুন্ডা এনে তৃণমূল কর্মীদের মারধর করছে। তার পর বলছেন, “শুনুন, যদি ইলেকশনটা গণতন্ত্র হয়, ইলেকশনটা যদি মানুষের ভোটে হয়, ইলেকশনটা কাকে মানুষ ভোট দেবে, কাকে দেবে না তার উপর ভিত্তি করে হয়, তা হলে গুন্ডামি করার প্রয়োজন নেই। গুন্ডামিটা করে কারা? যারা দেখে জেতার আশা নেই, তারাই গুন্ডামি করে।”
এক সময়ে সিপিএমের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়াই করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু রাস্তায় বাধা পাওয়া নয়, সংসদের মধ্যেও তাঁকে বিরক্ত করতেন বামেরা। ২০০৪ সালের ভোটের পর যখন লোকসভায় যখন তৃণমূলের একমাত্র সাংসদ মমতা, তখন তিনি বলতে উঠলেই সিপিএমের অনেক প্রবীণ সাংসদকেও দেখেছি কারণে অকারণে হল্লা করে বাধা দিতে। বরং তখন তাঁর প্রতি সহানুভূতি দেখাতেন লালকৃষ্ণ আডবাণী-রাজনাথ সিংরা।
তাই বলা যেতে পারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, গুন্ডামি তারাই করে যাদের জেতার আশা থাকে না। এ কথা এমনিতেই অকাট্য, তর্ক দিয়েও খণ্ডন করা যায় না। তা ছাড়া ডান-বাম, ব্রাত্য-দোলা, মিমি-নুসরত, গুরুং-আব্বাস মায় বাংলার বর্তমান রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবিসংবাদিত ভাবে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সুতরাং তিনি যে কথা বলছেন, তার ওজনও স্বাভাবিক ভাবেই বেশি।
এ বার সেই মাননীয়ার কাছেই বিনীত প্রশ্ন, আঠারো সালে পঞ্চায়েত ভোটে গুণ্ডামি করেছিল কারা? কারা দুই জেলার ৯০ শতাংশ বেশি আসনে বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দিতে দেয়নি? কারা বাংলার ২ কোটি মানুষকে তাঁদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগে বাধা দিয়েছিল? তারা কি বুঝেছিল যে জেতার একেবারেই আশা নেই, তাই কি গুন্ডামি করেছিল?
পঞ্চায়েত ভোটের আগের রাতে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাকদ্বীপে এক সিপিএম কর্মী ও তাঁর স্ত্রীকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার অভিযোগ উঠেছিল। সেই ঘটনার নেপথ্যে কারা ছিল? কারা ব্যালট বাক্স পুকুরে ফেলে দিয়েছিল, কারা গণনা কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট জ্বালিয়ে দিয়েছিল?
পঞ্চায়েত ভোটে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কোনও ভূমিকা থাকে না। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের পৌরোহিত্যেই তা হয়। সুতরাং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোমবার যখন গণতন্ত্রের কথা বলছিলেন, তখন নিশ্চয়ই অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে— পঞ্চায়েত ভোটে যখন স্রেফ গুন্ডামি করে মানুষের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা হয়েছিল, তখন বাংলার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক আসনে বসে থাকা নেত্রী কেন এদিনের মতো গর্জে ওঠেননি।
ব্যাপারটা শুধু পঞ্চায়েত ভোট পর্যন্ত থেমে থাকলে এক রকম ছিল। তার পর লোকসভা ভোট হল। দেখা গেল, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, উত্তর চব্বিশ পরগনা, হুগলি, বীরভূম, মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন ব্লকে বিরোধীরা অভিযোগ করছেন, বুথে তাদের এজেন্টকে বসতে দেওয়া হচ্ছে না, কিংবা শাসানি দেওয়া হচ্ছে। আর করিমপুরের উপনির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী জয়প্রকাশ মজুমদারের বুকে লাথি মেরে কচু বনে ফেলে দেওয়া তো ঐতিহাসিক। সেদিন কি নবান্নে বসে মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা গিয়েছিল যে, গুণ্ডামি যারা করেছে তারা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক!
আরও আছে। করিমপুরের নির্বাচনের স্মৃতি যদি ফিকে হয়ে যায়, তা হলে রয়েছে ডায়মন্ড হারবার। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবারে সভা করতে যাচ্ছিলেন। তাঁর কনভয়ে ইট মারল যে গুন্ডারা, যে ইটের ঘা খেয়ে তৃণমূলের একদা সেকেন্ড ম্যান যিনি ঝড়-জল-বিপদে সমান ভাবে পাশে ছিলেন, সেই মুকুল রায়ের আঙুল ভাঙল। সেদিন কি গুন্ডাদের বকাবকি করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী! যতদূর মনে পড়ে, তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায় পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন, অভিষেকের নির্বাচন কেন্দ্রে জেপি নাড্ডাকে কে যেতে বলেছিল! আর মুখ্যমন্ত্রী নাড্ডা, চাড্ডা, গাড্ডা, ফাড্ডা ইত্যাদি বলেছিলেন। জেপি নাড্ডা উগ্র রাজনীতিক নন। তাঁর মতাদর্শের সঙ্গে বাংলায় বহু লক্ষ মানুষের মতান্তর রয়েছে। গণতন্ত্রে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গুন্ডামি করে তাঁকে আটকানো কি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শোভা পায়?
বাংলার ভোটে কংগ্রেসের ভূমিকা কী ছিল তা বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই দেখেননি। জন্ম থেকে তাঁরা বাম শাসন দেখছেন। কেশপুর, গড়বেতা, নানুর, ছোট আঙারিয়ার মতো ঘটনা দেখেছেন। খবরের কাগজে রোজ পড়েছেন। সেই সঙ্গে এও দেখেছেন, গ্রাম বাংলায় পঞ্চায়েত ভোটে স্রেফ পেশী শক্তির জোরে আর ভয় দেখিয়ে কীভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একের পর এক পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ দখল করা হত। শুধু পঞ্চায়েত কেন কলকাতা ও তার উপকণ্ঠে পুরসভাগুলোর ভোটে পর্যন্ত হাজার হাজার বুথে এজেন্ট দিতে পারত না বিরোধীরা।
এগারো সালে বাংলায় পরিবর্তনের পর মানুষ আশা করেছিল, রাজ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরবে। নিজের ভোট নিজে দিতে পারবে বাংলার নিজের মেয়েরা, মায়েরা। কিন্তু তা হয়েছে কি! বরং পরিস্থিতি এমনই যে লোকসভা ভোটের ফলাফল দেখে রাজ্যে একশ’র কাছাকাছি পুরসভায় ভোট না করিয়ে প্রশাসক বসিয়ে রাখতে হয়েছে। পাছে গুণ্ডামি হয় ও মানুষ তাতে রেগে যায়! সেও তো আপাদমস্তক অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এতগুলো পুরসভার মানুষ যথাযথ পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
মোদ্দা কথা হল, গণতন্ত্রের অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় মানুষ কিন্তু আপনাকে দেখতে চেয়েছিল অতন্দ্র প্রহরায়! কিন্তু দেখা গেল, বদলা নয় বদল চাই— স্লোগানটাই সার। বাংলায় নির্বাচনী হিংসার বদল হয়নি। গুন্ডামির ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। এবং ভোটের দোরগোড়ায় পৌঁছে সেই গুন্ডামিকে ভৎসর্নার করার প্রয়োজন পড়ছে আপনার।
কে জানে কে ভয় পাচ্ছে!