
দ্য ওয়াল ব্যুরো: ৫৩ দিন নিখোঁজ থাকার পর খোঁজ পাওয়া গেল বাংলাদেশের আলোকচিত্রী ও সাংবাদিক সফিকুল ইসলাম কাজলের। মার্চ মাসের ১০ তারিখে নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি তিনি। সিসিটিভি ফুটেজ বলেছিল, ওই দিন সন্ধেয় অফিস থেকে শেষ বেরোতে দেখা গেছে তাঁকে। তার পরে যে কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিলেন একটি গোটা মানুষ। দুশ্চিন্তায় ছিলেন তাঁর পরিবার-সহ গোটা বাংলাদেশের শিল্পী ও সাংবাদিক মহল।
অবশেষে চিন্তার অবসান হল। যদিও তাঁর খোঁজ মেলার সঙ্গে সঙ্গেই অনুপ্রবেশের মামলায় পুলিশ গ্রেফতার করেছে তাঁকে। জানা গেছে, এত দিন নিখোঁজ থাকার পরে শনিবার রাতে তাঁর ছেলে মনোরম পলককে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের সাহায্যে ফোনে যোগাযোগ করেন সাংবাদিক কাজল । তাঁর ফোনের পরে সকলে এটুকু নিশ্চিত হন, বেঁচে আছেন কাজল।

এর পরেই বিজিবির তরফে জানানো হয়েছে, বেনাপোলের সাদিপুর সীমান্ত দিয়ে তিনি অনুপ্রবেশ করছিলেন বাংলাদেশে। সেসময়েই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে তাঁকে বেনাপোল থানার হাতে তুলে দেওয়া হয়।
এই গোটা পর্বে প্রশ্ন অবশ্য থেকেই গেছে, এতগুলো দিন কোথায় ছিলেন কাজল? কী হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। তিনি কি স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করেছিলেন, নাকি খারাপ কোনও পরিস্থিতির মুখে পড়েছিলেন, তা জানেন না এখনও কেউই।

গতকাল রাতে টেলিফোনে খবর পাওয়ার পরে রাতের বেলাতেই কাজলের পরিবার বেনাপোলের উদ্দেশে রওনা দেয় ঢাকা থেকে। সকালে বেনাপোল পোর্ট থানা থেকে যশোর আদালতে নিয়ে যাওয়া হয় কাজলকে। থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি জানান, বিজিবি তাঁকে পাসপোর্ট ছাড়া বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময় উদ্ধার করেছে। তাই তাঁর বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের মামলা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: একের পর এক সাংবাদিক নিখোঁজ উহান থেকে! দু’মাস পরে খোঁজ মিলল এক জনের, কী বলছেন তিনি
রবিবার সকালে কাজলের পরিবার যশোর আদালতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারে অবশেষে। কাজলের ছেলে পলক জানিয়েছেন, আদালতে তাঁর বাবার সঙ্গে কথাও হয়েছে। তবে এতদিন কোথায় কীভাবে ছিলেন, সে বিষয়ে কিছুই বলেননি কাজল।
কাজলের ছেলে মনোরম পলক জানিয়েছেন, গত ১০ মার্চ পুরনো ঢাকার বক্সীবাজারের বাড়ি থেকে কাজে বেরিয়েছিলেন কাজল। তার পর থেকেই আর যোগাযোগ করা যায়নি তাঁর সঙ্গে। পলকের মা অর্থাৎ কাজলের স্ত্রী জুলিয়া পরের দিনই থানায় নিখোঁজ ডায়েরি লেখান। কিন্তু কোনও রকম খোঁজ দিতে পারেনি পুলিশও। কাজল যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যান! এর পরে ১৮ মার্চ অজ্ঞাতপরিচয় অপরাধীদের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা করেন পলক। এর পরেই সোশ্যাল মিডিয়া মারফত ছড়িয়ে পড়ে কাজলের হারিয়ে যাওয়ার খবর। তাঁকে খুঁজে বের করার আহ্বান জানায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ফোরাম অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও।
কাজলের পরিবার জানিয়েছে, মেহেরপুরের আদি বাসিন্দা কাজল বাম রাজনীতির সমর্থক। একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটি বই-ও লেখেন তিনি। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমে কাজ করেছেন। অভিযোগ, কাজলের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না পুলিশ। পলক বলেন, “সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, কয়েক জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি সন্দেহজনক আচরণ করছে। অথচ পুলিশ ওই ফুটেজে রহস্যময় কিছুই দেখছে না।”
জানা গেছে, নিখোঁজ হওয়ার ঠিক আগের দিন অর্থাৎ গত ৯ মার্চ রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে কাজল-সহ ৩১ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলাটি করেন আওয়ামী লীগের এক সাংসদ। এর পরের দিন ১০ মার্চ কাজল নিখোঁজ হওয়ার তিন ঘণ্টার মাথায়, রাত ১০ টা ১০ মিনিটে ফের কাজলের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দ্বিতীয় মামলাটি করেন আওয়ামী লীগের আর এক নেতা।
এই বিষয়গুলি তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করেছে কাজলের পরিবার। বারবার জানিয়েওছে পুলিশকে। কিন্তু পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল বলেই অভিযোগ তাদের। কাজলের ২০ বছরের ছেলে মনোরম পলকের লেখা একটি চিঠি ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
সে চিঠির একটি অংশে পলক লিখেছেন, “আমি তোমাকে ফেরত আনার চেষ্টা করছি। অনেকে বলছেন, আমি ছেলে হিসেবে অনেক করছি। আমি ছেলে হিসেবে পর্যাপ্ত করেছি, এ কথা তখনই ভাবতে পারব যখন তোমাকে আমাদের মাঝে আবার ফেরত পাব। কেউ কেউ বলছেন, আমার মতো ছেলে তাদের যদি থাকত! পিতামাতাকে তাদের সন্তানের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলে যে কোন সন্তানই তাদের পিতামাতাকে ফেরত পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে। আমিও তাই করছি। আমি আমার বাবা-মা কে চিনি। আমি জানি না আমার বাবা-মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা-মা কিনা। কিন্তু আমি জানি, তোমাদের থেকে শ্রেষ্ঠ বাবা-মা আমার কখনও হতে পারত না। আমি সবসময়ই জানতাম, তোমার আর মার আমার থেকে যোগ্য সন্তান প্রাপ্য ছিল। পিতাকে নিয়ে চলে যাওয়ার ২০ দিন পরেও যে সন্তান তার পিতাকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি, সন্তান হিসেবে তার যোগ্যতা কী? এমন ছেলে থেকে কী লাভ?”
এই চিঠি ভাইরাল হওয়ার পরেই সারা দুনিয়ার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল কাজলের খবর। এতগুলো দিন ধরে একজন সাংবাদিক কোথায় আছেন, কী করছেন, সে বিষয়ে প্রশাসন কেন কোনও তথ্য পাচ্ছে না, প্রশ্ন উঠেছে আন্তর্জাতিক মহলে। সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়ে যায় এক ভার্চুয়াল মানববন্ধন। ‘হোয়্যার ইজ় কাজল’। মহামারীর মধ্যেও চলে ক্যাম্পেইন, প্রচার, পিটিশন। স্বাধীনচিন্তার লেখালেখির মাসুলই কি দিতে হচ্ছে কাজলকে? এমনটাই আশঙ্কা অনেকের।
তবে সকলকে নিশ্চিন্ত করে কাজলকে জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেলেও, তাঁর সঙ্গে ঠিক কী ঘটেছিল তাই নিয়ে আশঙ্কা ও জল্পনা থেকেই যাচ্ছে।