
অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়

বিজ্ঞানচেতনার এখন সত্যি খুব অধঃপতিত দশা। মূল কারণ ব্যবসা-কেন্দ্রিকতা। ইনোভেশনের চেয়ে ব্যবসায়িক গুরুত্ব প্রাধান্য বেশি পেলে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে যায়। কার্যকারিতা হারায়।
তথৈবচ টেস্টিং কিটের গল্প। ক’দিন আগে জানলাম, রাজস্থানে ৯৫ শতাংশ টেস্ট রিপোর্ট ভুল। এর আগে স্পেন, ইতালি থেকেও একই রকম খবর এসেছে। যাকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে করা হচ্ছে, সেই RT-PCR টেকনোলজিতেও ভুল বেরোনোর সম্ভাবনা প্রায় চল্লিশ শতাংশ। বাকি অ্যান্টিবডি টেস্টের অপার সীমাবদ্ধতা।
রোগটা ছড়িয়ে পড়েছে। থাকবে সে পৃথিবীতে। তার ওপর ভা্ইরাসের মিউটেশন ঘটছে। কাল হয়তো নতুন করে হু বলতে পারে, এটা airborne বা HIV-র মতো ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি সৃষ্টি করে। HERD ইমিউনিটিও তৈরি হচ্ছে না। তার মানে, সংক্রমিত হবার টাইমলাইন লম্বা। তাই জানতে হবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সঠিক নিরাময় পন্থা Convalescent plasma থেরাপি, আরোগ্যপ্রাপ্তের রক্তরস দিয়ে চিকিৎসা।
Convalescent plasma (CP, এরপর থেকে CP শব্দটাই ব্যবহার করব) সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার জন্যই এই আলোচনা। একটু ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক। ১৯৪০ সাল থেকে মাইক্রোবায়োলজি ব্যবহার করে চিকিৎসার প্রসার ঘটেছিল। তার আগেই ১৮৯০ সাল থেকে মহামারীতে CP চিকিৎসা ব্যবহার শুরু হয়েছিল। রক্ত থেকে প্লাজমা বের করার পদ্ধতি (প্লাজমাফেরেসিস) বর্তমানে অনেক আধুনিক হয়েছে। CP-র সঠিক বিধিসম্মত ব্যবহার নিয়ে আসবে সমাধানসূত্র। নিশ্চয়ই ভ্যাকসিন, মেডিসিন বের হবে, অধৈর্য না হয়ে উপযুক্ত সময় দিতে হবে।
দেখা যাচ্ছে, অসুস্থতা থেকে সুস্থতায় ফেরা মানুষের অনুপাত ৫:৪। অর্থাৎ একশোজন অসুস্থ মানুষের আশিজনই দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছেন। এই সুস্থ লোকেদের রক্তরসই ওষুধ। সেরে ওঠা ( তার নির্ধারিত মাপ আছে ) মানুষের রক্তের রক্তরস ২০০ ml করে ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে দুবার অসুস্থ মানুষের রক্তে প্রয়োগ করতে হবে ( অভিজ্ঞ রক্তবিজ্ঞান চিকিৎসকের উপস্থিতি ও নির্দেশ মেনে)। রক্তরসের অ্যান্টিবডি ঘাতক ভাইরাস অ্যান্টিজেনকে প্রতিহত ও নিউট্রালাইজ করবে। এই প্রতিষেধক পেতে গেলে Covid-19 থেকে সেরে ওঠা মানুষকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং নিয়ম মেনে সঠিকভাবে নির্ধারণ ও চয়ন করতে হবে আরোগ্যপ্রাপ্ত মানুষের রক্তরস।
গ্রুপ টেস্টিং, ক্রসম্যাচ টেস্টিং, অ্যান্টিবডি টাইটার নির্ধারণ খুবই চেনা সব পদ্ধতি ব্লাড ব্যাঙ্ক বা ল্যাবরেটরি টেকনোলজিস্টদের কাছে। তাছাড়া রিস্ক বেনিফিট অ্যাসেসমেন্ট CP চিকিৎসা পদ্ধতিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ। এ বিষয়ে মেডিক্যাল ট্রায়াল সম্বন্ধে ধারণা থাকা জরুরি। রিসার্চ ল্যাবে আবিষ্কার হওয়া থেকে মানুষের থেরাপিতে প্রয়োগের মাঝখানে চারটি ধাপ থাকে।
১. অন্য কোনও প্রাণীর দেহে পরীক্ষা।
২. মানুষে প্রয়োগ করে রিস্ক বেনিফিট অ্যানালিসিস।
৩. বেনিফিট বেশি হলে তার চিকিৎসা প্রয়োগ পদ্ধতি নির্ধারণ।
৪. সর্বসাধারণের ক্ষেত্রে প্রয়োগে বিপ্রতীপ মাত্রা নির্ণয়।
সব ধাপ পেরোলে তবে প্রচার, প্রসার, বিক্রিবাটা। জীববিজ্ঞান খোদার ওপর খোদকারি। প্রচুর ভ্যারিয়েবল। মেসি বা রোনাল্ডোর পেনাল্টি বক্সের বাইরে ফ্রি কিকের মতো। গোল হতেও পারে, নাও পারে। আমরা ভারতে CP-র স্টেজ-২ ট্রায়ালে আছি। ICMR-এর তত্ত্বাবধানে দ্রুত গতিতে কাজ চলছে।
স্বয়ং বিল গেটস বলেছেন, ভারত Covid-19 মোকাবিলায় প্রশংসার দাবি রাখে। সত্যি প্রশংসা প্রাপ্য দেশবাসীর। আমেরিকা, ইউরোপের কিছু দেশ অর্বাচীনের মতো ম্যানেজ করতে গিয়ে নাজেহাল। নিয়ম মানতে হবে। সকল নেতা ও নেত্রীকে হতে হবে সৎ ও সমবেত। CP চিকিৎসা পদ্ধতি পাওয়ার প্রাকলগ্নে বিশ্বাস হারালে চলবে না। অসুস্থ হলে ঘাবড়াবেন না। হলেও সেরে উঠবেন। রাজনীতির কুপ্রভাব থেকে সরে থাকলেই লড়াইটা আমরা জিতলাম বলে। মহামারীর বিরুদ্ধে জয় হয়ে আমার, আপনার, সবার প্রিয়তম সার্টিফিকেট।
তথ্য সহায়তা: ডাক্তার শুভ্র দত্ত, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন, টাটা মেডিক্যাল সেন্টার
(লেখক ল্যাবরেটরি বিজ্ঞান সংক্রান্ত বহুজাতিকে কর্মরত। মতামত ব্যক্তিগত।)