
দ্য ওয়াল ব্যুরো: যেদিন বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর খবর মেলে, সেই তারিখটা ছিল মার্চ মাসের ৮ তারিখ। ঘটনাচক্রে, তারিখটি সারা বিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস হিসেবে। করোনাভাইরাসের সঙ্গে নারীদিবসের কোনও সম্পর্ক সেই অর্থে না থাকলেও, বাংলাদেশের করোনা-যুদ্ধে একজন নারীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল সেই নারীদিবস থেকেই। এতটাই গুরুত্বপূর্ণ সে ভূমিকা, যে এই দু’মাসের মধ্যে তাঁর আসল নামটাই ভুলে যেতে বসেছেন অনেকে। ‘করোনা আপা’ বলেই জনসাধারণের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছেন তিনি।
ময়মনসিংহ নগরের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা করোনা আপার নাম বাবলি আকন্দ। পেশায় সাংবাদিক তিনি। একইসঙ্গে তিনি যুক্ত কিছু সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কাজের সঙ্গে। আর সেই কাজের অভিজ্ঞতা থেকেই হোক বা নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে, এই করোনা পরিস্থিতিতে কিছু করার কথা ভাবেন তিনি। কিন্তু ঘরবন্দি থাকা অবস্থায়, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে, পথে নেমে কাজ করাও তো মুশকিল! এই মুশকিল বিষয়টিই মানুষকে বোঝানোর দায়িত্ব নেবেন বলে ঠিক করেন বাবলি।
প্রথম কয়েক দিন ধরেই নানা প্রান্ত থেকে খবর আসতে থাকে, নিয়ম নীতি না মেনেই লকডাউনের আইন ভঙ্গ করছেন অনেকে। বাবলির মনে হয়, মানুষের মধ্যে সচেতনতাই জন্মাচ্ছে না। তাই এলাকায় সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, লকডাউন মেনে চলার বার্তা দিতে শুরু করেন তিনি। ২০ জন স্বেচ্ছাসেবীকে নিয়ে তৈরি করেন নিজের টিম। সকলকে বোঝাতে শুরু করেন বিপদের কথা, প্রয়োজনীয় কর্তব্যের কথা।
বাবলি বলেন, কাজ শুরুর দিকে বিষয়টি নিয়ে অনেকেই হাসাহাসি করতেন। বিদ্রূপ করতেও ছাড়েননি অনেকে। এই বিদ্রূপের জেরেই তাঁকে একদল তরুণ ছেলে ডেকে বসে ‘করোনা আপা’ বলে। এই ডাক তাদের কাছে খুবই হাস্যকর ও ব্যঙ্গাত্মক হলেও, পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার পরে এখন সবাই তাঁকে ভালবেসেই ‘করোনা আপা’ বলে ডাকেন। আগের মতো আর খারাপও লাগে না বাবলির। অস্বস্তির বদলে বরং আনন্দই হয়। বিদ্রূপ নয়, সম্মান বলে মনে হয় এই ডাকটা।
শুধু সচেতনতা প্রচারই নয়। কোথায় কোন দরিদ্র পরিবারের ঘরে চাল নেই, খাবার নেই, একটা ফোন করলেই হল করোনা আপাকে। খাবারের ব্যবস্থা করে তিনি ছুটেছেন সমস্যার সমাধান করতে। সবসময় সকলের চাহিদা একা পূরণ করতে পারেন না বাবলি, তখন জেলা প্রশাসক, ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের জানান তিনি। অনেক সময়ে নিজের উদ্যোগে টাকা তুলে মানুষের খাদ্য ও ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থা করে দেন। এই করেই করোনা আপা যেন এখন সাক্ষাৎ দেবদূত!
বাবলি বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুতে নিজের এলাকার মানুষকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে কয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করেন তিনি। ঠিক করেন, মানুষকে বোঝাতে হবে। এতে তাঁর বন্ধুরা কেউ রাজি হন, আবার কেউ ভয়ও পান। শেষমেশ যাঁরা আগ্রহী ছিলেন তাঁদের নিয়ে করোনা প্রতিরোধে মানুষকে সচেতন করতে বাবলি নেমে পড়লেন শহরের রাস্তা, অলিগলি ও বাজারে।
শুরুতে বাবলির পরিবারেরও সমর্থন ছিল না। থাকবেই বা কী করে, ৩ বছরের ছোট্ট এক সন্তানের মা বাবলি। বয়স্ক মাও আছেন বাড়িতে। এই অবস্থায় বাবলি নিজে সংক্রামিত হলে তাঁরাও বিরদে পড়বেন। বাবলির স্বামী পাশে দাঁড়ান। পেশায় আইনজীবী মানুষটি একাই পরিবারের সবাইকে বোঝান পরিস্থিতির গুরুত্ব। এর পরেই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওয়ার্ডভিত্তিক যে স্বেচ্ছাসেবক বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শুরু হয়, তাতে ফর্ম ভরেন বাবলি। তিনি এখন জেলা প্রশাসন অনুমোদিত ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসেবী।
হাতে গ্লাভস, মাথায় টুপি, মুখে মাস্ক। রণসাজে সজ্জিত হয়ে রোজ বেরোন বাবলি। হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে সচেতনতার বার্তা।ল কখনও মাইক্রোফোনে চলছে প্রচার। জেলার নানা প্রান্তে নানা প্রয়োজনে এভাবেই ছুটে বেড়ান করোনা আপা। কয়েক দিন আগেও যাঁরা দুয়ো দিত তাঁর উৎসাহ দেখে তাঁরাই আজ প্রশংসায় ভরিয়ে দেন তাঁকে। সকলের ভালবাসার ‘করোনা আপা’ হতে পেরে প্রথমের সে দুঃখ ভুলেছেন বাবলি নিজেও।