
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
সারদা কৃষ্ণমূর্তি, তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে হয়েও যার মননে বাংলা ও রবি ঠাকুর। সারদা পরে কবিতা নামেই বিখ্যাত হন। পদ্মশ্রী কবিতা কৃষ্ণমূর্তি। তাঁর বিশাল সঙ্গীত জীবনে তিনি একের পর এক সঙ্গীতশৃঙ্গ জয় করেছেন। আজ তিনি শিখরে। লিভিং লেজেন্ড গায়িকা কবিতা কৃষ্ণমূর্তি তামিল বংশোদ্ভূত মেয়ে হয়েও এত ভাল ও স্পষ্ট উচ্চারণে বাংলা বলেন কীভাবে? বাংলা গান গাওয়া শুধু নয় অবিরত বাংলায় কথা বলে যেতে পারেন তিনি।
তিনি একদিকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রানি, অন্যদিকে শ্রীদেবীর লিপে ‘হাওয়া হাওয়াই’ বা দেবশ্রী রায়ের লিপে ‘কলকাতার রসগোল্লা’। ভাবাই যায় না সঙ্গীতের সমস্ত ধারায় তিনি কীভাবে সেতুবন্ধন করেন! কিন্তু কবিতাজীর সঙ্গীতজীবনের শুরু কীভাবে হয়েছিল? কবিতার আসল নাম সারদা। তাঁর জন্মদায়িনী মা তামিল হলেও কবিতার পালিকা মা বাঙালি।

সারদার মা কামাক্ষি কৃষ্ণমূর্তির অভিন্ন হৃদয় প্রতিবেশী বান্ধবী ছিলেন এক বঙ্গবধূ, প্রতিমা ভট্টাচার্য। দুজনের স্বামীও ছিলেন খুব বন্ধু এবং দুজনেই সরকারি চাকুরে। দিল্লিতে প্রতিমার স্বামী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এবং কামাক্ষির স্বামী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করতেন। সারদা হওয়ার আগে থেকেই এই তামিল আর বাঙালি পরিবার এক পরিবার হয়ে গেছিল। সারদার মা প্রতিমাকে তাঁর বড়দিদি, মা– সব ভাবতেন। প্রতিমার দায়িত্বেই কামাক্ষির কোল আলো করে এল সারদা। সারদা কামাক্ষিকে ডাকল মা বলে আর প্রতিমাকে মামণি বলে।
কিন্তু এরই মধ্যে ঘটল একটা ঘটনা। সারদার বাবার চাকুরিতে একটা প্রমোশান হল। তিনি ডেপুটি সেক্রেটারি হয়ে বড় বাড়ি পেলেন। কিন্তু সারদার মা বললেন, ‘প্রতিমাদিরা যদি আমাদের সঙ্গে না আসেন, আমরা যাব না কোথাও। এই ছোট বাড়িতেই থাকব।’ তখন সারদার পিতা মিস্টার কৃষ্ণমূর্তি, মিস্টার ভট্টাচার্যকে বললেন, “আমার বড় বাড়িতে আমরা দুই পরিবার কি একসঙ্গে থাকতে পারি না?”
সেই কথায় ভট্টাচার্য পরিবার আর কৃষ্ণমূর্তি পরিবারের একসঙ্গে থাকা এক বাড়িতে শুরু হল।
দুই প্রদেশের মানুষের বন্ধুত্ব যে এত গভীর হতে পারে তাতে এঁরা সত্যিই দৃষ্টান্তস্বরূপ। বাড়িতে ছিল দুটো রান্নাঘর। বাঙালি হেঁসেলের মাছ আর তামিল হেঁসেলের দক্ষিণী নিরামিষ পদ দিয়েই দু’পরিবারের অন্তরঙ্গতা বেড়ে চলল। এভাবেই বাঙালির মাছেভাতে বড় হয়ে উঠলেন তামিলকন্যা সারদা।
মামণি প্রতিমা বললেন “সারদা তো আমারই মেয়ে। ও বাঙালি। সারদাকে আমি রবীন্দ্রনাথের গান শেখাব।” দিল্লি কালীবাড়ির কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষিকা সুরমা বসুর কাছে সাত বছরের সারদাকে ভর্তি করে দিলেন প্রতিমা ভট্টাচার্য। সঙ্গীতশিল্পী শানের পিতা মানস মুখার্জীও কবিতা কৃষ্ণমূর্তির গানের শিক্ষাগুরু।
সে সময়ে সারদা-প্রতিমাদের বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে একজনই পথপ্রদর্শক বন্ধুস্বরুপা ছিলেন, তিনি হেমা মালিনী এবং তাঁর মা। তখন হেমা মালিনী ড্রিম গার্ল হয়ে গেছেন, বড় ফিল্মস্টার। প্রতিমা মামণি সারদাকে বললেন “তোকে আমি বম্বে নিয়ে যাব, ওখানে কলেজে পড়াশোনা করবি। গান বাজনা ওখানে হলে আরও ভাল।”
১৯৭০-৭১ সালে বম্বের সেন্ট জেভির্য়াস কলেজে ভর্তি হলেন সারদা। কলেজেও সারদার সব বন্ধুরাই প্রায় বাঙালি। আশ্চর্যজনক ভাবে বাঙালি কানেকশনই সারদাকে বারবার তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছে। কলেজে যিনি সারদাকে ভর্তি করলেন তিনি ফিল্মস্টার পরিচালক গুরু দত্তর ছোট ভাই। উনিও বাংলায় কথা বলেন। আবার কলেজে সারদার বেস্ট ফ্রেন্ডও বাঙালি হেমন্তকন্যা রাণু মুখোপাধ্যায়। একই ব্যাচের ছাত্রী। কলেজ সোশ্যালের ফাংশানে একসঙ্গেই গান গেয়েছিলেন রাণু আর সারদা।
সেখানেই মঞ্চে উঠে গান গাওয়ার সময় সারদার চোখে পড়ল দর্শকাসনে বসে আছেন স্বয়ং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সারদার গান শুনে রাণুকে বললেন, “ডাকো তোমার বন্ধুকে।” ভয়ের চটে হেমন্ত কুমারের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে দাঁড়িয়ে রইলেন সারদা। তারপর সারদাকে হেমন্ত কুমার বললেন, “তুমি গান করবে আমার সঙ্গে স্টেজে? আমার মেয়ে রাণু তো সব জায়গায় যেতে চায় না গাইতে আমার সাথে। তুমি কি ইচ্ছুক?” সারদার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর মামণি প্রতিমা ভট্টাচার্য। তিনিই বললেন হেমন্তকে, “এ তো বিশাল বড় সুযোগ! আপনি যদি আপনার সঙ্গে সারদাকে গান করতে নেন!”
সেই যে শুরু হল, তার পর যেন স্বপ্নালোকের দরজা খুলে গেল সারদার জন্য। ভগবান হয়ে সারদার জীবনে এলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
কিন্তু সারদা নাম নিয়ে ঝামেলা হল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মঞ্চে গান গাইতে গিয়ে সারদা নাম যখন মাইকে ঘোষণা হল, দর্শকরা বলল ‘তিতলি উড়ি উড় জো চালি’ গাইতে। স্কুলগার্লের মতো সারদা স্টেজে দাঁড়িয়ে বললেন “আমি তো ওই সারদা আর্টিস্ট নই, যিনি বৈজয়ন্তীমালার লিপে গেয়েছেন। আমি নতুন মেয়ে, লতাজির গান গাইব হেমন্তদার সাথে।”
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তখন সারদাকে বললেন, “তোমার এই নাম চলবে না।” তখন মামণি প্রতিমা বললেন সারদাকে, “আজ থেকে তোর নতুন নাম দিলাম কবিতা। আজ থেকে তুই কবিতা হয়ে গেলি।” হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথাতেই সারদার নাম পাল্টে হল কবিতা। হঠাৎ একদিন হেমন্তর ফোন কবিতার বাড়িতে, “আগামীকাল আর কলেজ যেতে হবে না, তুমি গান রের্কডিংয়ে চলে এসো রাজকমল স্টুডিওতে।”
স্টুডিওতে গিয়ে কবিতা দেখল তাঁকে গাইতে হবে ডুয়েটে কটা লাইন। রবীন্দ্রসঙ্গীত, “সখী ভাবনা কাহারে বলে।” ‘হেমন্তদা গানটা কার সাথে গাইব?’ জিজ্ঞেস করলেন কবিতা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বললেন ‘এই তো লতা আসছে।’ শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল কবিতার। জীবনের প্রথম প্লে-ব্যাক তাও আবার কিংবদন্তী লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে! গান রেকর্ডিংয়ের সময়ে ভয়ে কটা লাইন ভুলে গেলেন কবিতা। হেমন্ত বললেন ‘কী, তুমি গাইলে না?’ লতাজি চশমাটা ঝুঁকিয়ে কবিতার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তখন মনে বল পেলেন কবিতা।
কবিতা কৃষ্ণমূর্তির প্রথম প্লে-ব্যাকও বাংলা ছবিতে। তরুণ মজুমদারের ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’। সন্ধ্যা রায়ের লিপে গাইলেন কবিতা আর নবাগতা নায়িকা মহুয়া রায়চৌধুরীর লিপে গাইলেন লতাজি … ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে।’
‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এ ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে’ সুপারহিট হওয়ার পরে এ গানটা বাঙালির বঙ্গজীবনের আইকনিক প্রেমের গান হয়ে গেল। এই রবীন্দ্রসঙ্গীতটা আগে সেভাবে বাঙালির ঘরে-ঘরে গাওয়া হতো না। কিন্তু ছবিটা হিট করতে গানের দৃশ্যটাও আইকনিক হয়ে গেল। এই রবীন্দ্রসঙ্গীত সবার মনের কথা, প্রেমে-বিরহে জাতীয় সঙ্গীত হয়ে গেল।
ভাবা যায়, সন্ধ্যা রায়ের লিপেই কবিতা কৃষ্ণমূর্তির প্রথম ফিল্মি গান শুরু!
শুধু তাই নয় হেমন্তর এক ফোনে মান্না দে বাইশ বছরের কবিতাকে তাঁর ওয়ার্ল্ড মিউজিক ট্যুরের ফিমেল সিঙ্গার করে নেন দীর্ঘ আঠেরো বছরের জন্য। যা ছিল কবিতা কৃষ্ণমূর্তির কাছে ভগবানের আশীর্বাদ।