
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
এক দুজে কে লিয়ে, ম্যায় নে পেয়ার কিয়া, সাগর, পাত্থরকে ফুল, সজন, হাম আপ কে হ্যায় কৌন, লাভ… আইকনিক সব ছবির আইকনিক গানে পুরুষ কণ্ঠ শুনলেই মনে পড়ে যাঁকে, তিনি এক ও একমাত্র এসপি বালাসুব্রহ্মণ্যম।
আট-নয়ের দশকের প্রেমের প্রতিনিধি যেন এসপি-র মায়াবি কণ্ঠস্বর। সে সময়ে কিশোর কুমার জমানাতেও, যেশুদাশের পরে যে দক্ষিণী কণ্ঠ বলিউড জয় করেছিল তিনি ছিলেন এসপি বালাসুব্রহ্মণ্যম ওরফে ইন্ডাস্ট্রির বালু।
কিশোরের কণ্ঠে ছিল কমেডি আবার গম্ভীর ভরাট পৌরুষ। আটের দশকের শেষ থেকে নয়ের দশক জুড়ে কিশোরপুত্র অমিত কুমার, কুমার শানুদেরও রমরমা বাজার বলিউড টলিউডে। কিন্তু ওঁরা যেন কিশোরকুমারকে সামনে রেখেই গান গাইতেন। কিশোরের অনুকরণ ও অনুসরণ করা কণ্ঠের ফ্লেভার পেত দর্শকরা। এমনই সময়ে বলিউডে এসেছিলেন এসপি বালাসুব্রহ্মণ্যম। আশি সালে প্রয়াত মহম্মদ রফির কণ্ঠের সেই মিষ্টতা যেন বালাসুব্রহ্মণ্যম ওরফে বালুর কণ্ঠে ফিরে পেলেন শ্রোতারা। তবে রফির অনুকরণ নয়, বালুর কণ্ঠে ছিল এক স্বতন্ত্র মিষ্টতা ও রোম্যান্টিকতার মিশেল।
বালাসুব্রহ্মণ্যম মাদ্রাজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকালীন সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে সুরসাধকদের চোখে পড়ে যান। এর পরে তেলেগু ছবিতেই প্রথম প্লেব্যাকের সুযোগ মেলে ১৯৬৬ সালে। দক্ষিণী গানে ক্রমশ বালু আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন। এক দিনে পনেরো থেকে কুড়িটা গান রেকর্ডিংও করেন তিনি। দক্ষিণে সহশিল্পী রূপে যে মহিলা শিল্পীদের বালু পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন পি সুশীলা, এস জানকী, বাণী জয়রাম প্রমুখ।
এর পরে বলিউডে বালুর অভিষেক ১৯৭৭ সালে ‘মিঠি মিঠি বাতেঁ’ ছবি দিয়ে, ‘দিল দিওয়ানা বড়া মাস্তানা’ গানে। তামিল গানে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির পরে বালু ফের সুযোগ পান বলিউডে ১৯৮১ সালে কমল হাসান ও রতি অগ্নিহোত্রী অভিনীত সুপার ডুপার হিট ছবি ‘এক দুজেকে লিয়ে’র হাত ধরে। ‘এক দুজে কে লিয়ে’ ছবিতে গান গেয়ে ফিল্মফেয়ার-সহ আবার জাতীয় পুরস্কারে সেরা পুরুষ কণ্ঠশিল্পী রূপে পুরস্কৃত হন এসপি বালাসুব্রহ্মণ্যম।
এর পরে ১৯৮৭ সালে বাংলা গানের শ্রোতাদেরও মন জয় করলেন বালু। আশির দশকের শেষ দিকটা যেন বাংলা গানের এক স্বপ্নালু রঙিন দিন ছিল। সে সময়ে সিঙ্গেল স্ক্রিনের রমরমা বাড়ছে, বলিউড ছবির নকলনবিশ বাংলা ছবির হাওয়াও ঢুকছে, তবু বাংলার আত্মাকে যেন ধরে রেখেছিল বাংলা গান। পুজো প্যান্ডেলের মাইক থেকে রাতে মাঠে সাদা পর্দা টাঙিয়ে ভিসিআরে দেখা ছবিতে এসব গান সকলের কাছে পৌঁছত। গ্রীষ্মের রাতের আড্ডা বা শীতের দুপুরের পিকনিকে যেন মধু ঝরাত এসব গান।
সেই সময়ে, ভিসিআর-এর যুগে ‘একান্ত আপন’ ছবির শুরুতেই এসপি বালাসুব্রহ্মণ্যম ও আশা ভোঁসলের পঞ্চমী সুরে ডুয়েট বাংলা গান ‘না না না কাছে এসো না’র সুর আর সেই সঙ্গে ভিক্টর-অপর্ণার হোটেলে ফুলসজ্জার সিঁদুরমাখা যৌনতার আবডালকে নয়া মাত্রা দিল বালুর কণ্ঠ।
এই হাল আমলেও বাংলা গানে দর্শককে পেয়েছেন শ্রোতারা। ‘চ্যাম্পিয়ন’ ছবিতে জিতের লিপে বালুর কণ্ঠে ‘বন্ধু বলে ডাকো যারে’ গানটি বাংলা কর্মাশিয়াল ছবির মরা গাঙে পাল তুলেছিল।
এক সময়ে বলিউডে বালু এবং সলমন খান হয়ে গেছিলেন এক আত্মা-এক প্রাণ জুটি। সলমন খান এত সাফল্য কোনও দিনই পেতেন না যদি না তাঁর কন্ঠে এসপি বালাসুব্রহ্মণ্যমকে পেতেন। ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’ এবং ‘হাম আপ কে হ্যায় কৌন’—দুটো ছবিতেই বালাসুব্রহ্মণ্যম এবং সলমন জুটি দিয়েছে একাধিক সুপারহিট গান, যে গুলো আজও মিউজিক চ্যানেলে সর্বোচ্চ টিআরপি দেয়।
‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’ সিনেমাটি ভাগ্যশ্রী এবং সলমনের কেরিয়ারে সবচেয়ে বড় হিট। এসপি-র গান ‘আতে যাতে’ থেকে ‘মেরে রং মে’, ‘দিল দিওয়ানা’ বা আইকনিক ‘কবুতর যা যা যা’ সে সময়ে টিনেজারদের যেন প্রেম শিখিয়েছিল।
রোম্যান্টিক চোখে, রোমশ আধখোলা বুকে দাড়িয়ে সলমন আর হাঁটু ছুঁয়ে ভাগ্যশ্রী– সে ছবি দেওয়া ক্যাসেট তখন সব ছেলেদের পকেটে। তখন তো মোবাইল, এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপের যুগ ছিল না, তাই তাই পায়রা উড়িয়ে ‘কবুতর যা যা’ বলে প্রেমের চিঠি পাঠাতে শিখেছিল অনেক কপোত-কপোতী। জানা নেই সেসব চিঠি পৌঁছেছিল কিনা প্রণয়ীদের হাতে।
১৯৯১ সালে এল আরও একটা ছবি, ‘লাভ’। সলমন-রেবতী অভিনীত ছবিটিতে ‘সাথিয়া তুনে ক্যায়া কিয়া’ গানটি বালু এবং চিত্রার কণ্ঠে কী বিশাল জনপ্রিয় হয়! দূর থেকে এই গানটা ভেসে এলেও কানে যেন একটা প্রেমের দখিনা বাতাস বয়ে যেত। আজ বালুর প্রয়াণে এই গানটা দিয়েই তাঁকে মনে করছেন অনেকে।
সেই বছরেই লরেন্স ডিসুজার ছবি ‘সজন’। সঞ্জয় দত্ত, মাধুরী দীক্ষিত, সলমন খানের ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। ‘তুমসে মিলনেকি তামান্না হ্যায়’ গানে সলমন তাঁর প্রেম মাধুরীর কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন। সেই ‘সজন’ ছবিতেই কুমার শানু এবং এসপি একসঙ্গে গাইলেন সেই অমর গান ‘জিয়ে তো জিয়ে ক্যায়সে’ যেখানে হৃদয় বিদারক বিচ্ছেদ হচ্ছে সঞ্জয়, মাধুরী আর সলমনের।
শুধু কি তাই, বালুর কন্ঠে এ আর রহমানের সুরে সেই ‘রোজা জানেমান’ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল। আর অবশ্যই বলতে হয় সলমন-মাধুরী অভিনীত ‘হাম আপ কে হ্যায় কৌন’ নামে, বক্সঅফিসে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ছবির কথা। ‘দিদি তেরা দেবর দিওয়ানা’ গানটি বাস্তবের বিয়ে থেকে সমস্ত অনুষ্ঠানে আইকনিক গান হয়ে গেল। মাধুরীর বেগুনি চুমকি বসানো শাড়ি আর সলমনের সাদা সাফারি ড্রেস। সঙ্গে লতা-বালুর গলা।
সলমন খানকে আজকাল মাসলম্যান ভাইজান হিসেবে যতই পরিচিত করা হোক, তাঁর প্রথম জীবনের নিষ্পাপ রোম্যান্সে রয়ে যাবে বালুর কণ্ঠের চিরকালীন ম্যাজিক। করোনাভাইরাসের মারণ ছোবল ৭৪ বছরের বালাসুব্রহ্মণ্যমের জীবন থামিয়ে দিল বটে, কিন্তু ভারতীয় সঙ্গীতের রোম্যান্টিক মেলোডির পাতায় তিনি থেকে যাবেন চিরভাস্বর হয়ে।