
শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
রবি কাপুরের জন্ম পঞ্জাবের অমৃতসরে। পিতা অমরনাথ কাপুর নকল গয়নার ব্যবসায়ী ছিলেন, যেসব গয়না ফিল্মের শ্যুটে সরবরাহ করা হত। এভাবেই একদিন বাবার আদেশ মেনে বলিউডের খ্যাতনামা ভি শান্তরামের ছবির জন্য গয়না দিতে যান রবি। সেখানেই ভাগ্যবদল রবির, ঘটে নাম বদলও।
ভি শান্তরামের ‘নবরং’ চলচ্চিত্রের জন্য গয়না সরবরাহ দিতে গেলে শান্তরাম সুদর্শন রবিকে তাঁর ফিল্মের জন্য পছন্দ করে নেন এবং সরাসরি ফিল্মের অফার। রবি নাম পাল্টে হয়ে গেলেন জিতেন্দ্র।
জিতেন্দ্রর ফিল্মজীবনে প্রথম আলোচিত সাফল্য আসে ভি শান্তরামের ১৯৬৪ সালের ‘গীত গ্যয়া পাত্থরোঁ নে’ চলচ্চিত্র দিয়ে। চার বছর পরে ১৯৬৭-তে ‘ফর্জ’ ছিল তাঁর আর একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। এই চলচ্চিত্রের ‘মস্ত বাহারোঁ কা ম্যায় আশিক’ গানের জন্য তিনি মুম্বইয়ের একটি দোকান থেকে নেওয়া টিশার্ট আর সাদা জুতো পরবর্তী কালে তাঁর প্রতীকী স্টাইল হয়ে দাঁড়ায়।
যদিও জিতেন্দ্র এর আগেই পড়াশোনা সেরে ফেলেন। তিনি মুম্বইয়ের গিরগোমের সেন্ট সেবাস্টিয়ান্স গোয়ান হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। সেখানে তার সহপাঠী ছিলেন রাজেশ খান্না। দুজনেই সুপারস্টার হওয়ার পরেও যাঁদের বন্ধুত্ব অক্ষুন্ন ছিল। জিতেন্দ্র এর পর মুম্বইয়ের সিদ্ধার্থ কলেজ থেকে স্নাতক হন।
কিন্তু জিতেন্দ্রর জীবনে রাজেশই শুধু বন্ধু নয়। আরও একজন ফিল্মলাইনের সুপারস্টার নায়ক জিতেন্দ্রর ব্যক্তিগত জীবনের অনেকটা জুড়ে। তিনি আর কেউ নন স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন।
রেখা, জয়া প্রদা, শ্রীদেবী– এই সব দক্ষিণী স্বপ্নসুন্দরীদের একমাত্র হিট হিরো জিতেন্দ্র। জিতেন্দ্র মানেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ব্যাকব্রাশ চুল, কার্তিকসুলভ গোঁফ, সাদা সাফারি শ্যুট আর সাদা জুতোর এক রোম্যান্টিক কোমল ইমেজ।
কিন্তু এই ইমেজ নষ্ট হয়ে যেতে বসেছিল জিতেন্দ্ররই নানা বদভ্যাসে। এসব থেকে জিতেন্দ্রকে মুক্তির পথ দেখান তাঁর পরম বন্ধু অমিতাভ বচ্চন।
কী ছিল সেই ঘটনা?
স্টারদের জীবনে অবসাদ মাঝেমধ্যেই গ্রাস করে, তখনই তাঁরা একটু মুক্তির মরীচিকায় নেশাকে অবলম্বন করেন। ঠিক এমনই এক নেশা ধূমপান। যে নেশা যে কতটা মারণ নেশা, সেটা তো আজকাল ভীষণ ভাবেই প্রমাণিত ও প্রচারিত।
কিন্তু ষাট-সত্তরের দশকে ধূমপান বিরোধী এত প্রচার একদমই ছিল না এ দেশে। বরং ধূমপান তখন ছিল পৌরুষের চিহ্ন, পৌরুষের স্টাইল। কিন্তু এই নেশা শেষ করে ধূমপায়ী ও তাঁর আশপাশের মানুষদেরও। তবে সে যুগে চুরুট বা সিগারেট মুখে নিয়ে ছবি তুললে নায়কের স্টারডম অনেক বেশি বেড়ে যেত। তাই সিগারেট তখন শুধু খাওয়ায় নয়, ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হিসেবেও ভীষণ ভাবে ইন।
জিতেন্দ্রর অভ্যাস ছিল দিনে আশিটা সিগারেট খাওয়ার, যা অতি ভয়ংকর অভ্যেস। সঙ্গে জিতেন্দ্র ছিলেন অতিরিক্ত মাত্রায় মদ্যপানেও অভ্যস্ত। অমিতাভ বচ্চনও সিগারেটের নেশায় বুঁদ ছিলেন একসময়। কিন্তু অমিতাভ ততদিনে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন।
জিতেন্দ্র স্ত্রী শোভা কাপুর তখন সন্তানসম্ভবা। শোভা বারংবার জিতেন্দ্রকে বোঝাতেন এইসময় জিতেন্দ্রর অতি ধূমপান কতটা অস্বাস্থ্যকর তাঁর প্রেগন্যান্ট স্ত্রী ও আগত সন্তানের জন্য। কিন্তু জিতেন্দ্র কিছুতেই ছাড়তে পারছিলেন না সিগারেট।

এরপর একদিন জিতেন্দ্র-শোভার প্রথম সন্তান একতা কাপুর জন্মগ্রহণ করেন। ঠিক এইসময়ই একদিন জিতেন্দ্রর সঙ্গে অমিতাভের দেখা। জিতেন্দ্র অমিতাভকে বললেন “অমিত আমি বুঝতে পারছি না কী করে ছাড়ব এই স্মোকিং। আমার সন্তানের জন্যও তো খারাপ এটা।”
অমিতাভ একবার তাকালেন জিতেন্দ্রর দিকে এবং তারপর জিতেন্দ্রর ঠোঁট থেকে সিগারেটটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলেন। বললেন, “কীভাবে ছাড়বে না ভেবে আজই ছেড়ে দাও। ঠিক যেভাবে আমি ধূমপান ছেড়েছিলাম।” অমিতাভ আরও বললেন, “সিগারেট ছুড়ে ফেলো এবং তোমার মেয়ের নামে প্রতিজ্ঞা করো আর সিগারেট স্পর্শ করবে না।”
অমিতাভের এই কথা জিতেন্দ্রকে একদিনেই অনুপ্রাণিত করল এবং তিনি ধূমপান ছেড়ে দেখাতে পারলেন। যখনই সিগারেট দেখতেন কোথাও, তখনই মেয়ে একতার মুখটা মনে পড়ত। আর ছুঁয়েও দেখতেন না সিগারেট।
এভাবেই জিতেন্দ্রর পরমবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন অমিতাভ বচ্চন। এমন উপকারী বন্ধুর ঋণ তো ভোলার নয়।