
কলকাতা ডার্বি : বাঙালির ৯৯ বছরের চিরন্তন লড়াইয়ের নানা ছবি, হাসি-কান্নার কোলাজ
শুভ্র মুখোপাধ্যায়
কলকাতা ডার্বি মানে অজস্র ইতিহাসের হাতছানি। এই ম্যাচ মানে কত হাসি-কান্নার সমারোহ, এই ম্যাচ মানে কত তারকার জন্ম, আবার কত সব ফুটবলার হয়ে গিয়েছেন ভিলেন, কেউ বা ব্যর্থতার অতলে তলিয়ে গিয়েছেন।
আবার এও হয়েছে, কেউ সাফল্য পেয়ে তাঁর মাথা ঘুরে গিয়েছে, তারপর ক্রমশ হারিয়ে গিয়েছেন প্রশংসার চক্রবুহ্যের মধ্যে পড়ে। উলটোটাও হয়েছে, বড় ম্যাচে ব্যর্থ হয়েছেন, তারপর সেই হার থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের সেরা তারকায় পরিণত হয়েছেন।
বাঙালির চিরন্তন লড়াই। রবীন্দ্রনাথ, রসগোল্লা, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল দ্বৈরথ বাঙালির হেঁসেলে প্রবেশ করেছে আদি অন্তকাল ধরে। ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে।’
এটাই এই লড়াইয়ের মাহাত্ম। কতসব মুখ এসে রঙিন করে দেয় এই ম্যাচ। কত বদলে যাওয়া মুখ, কতরকমের বহিঃপ্রকাশ।
শুক্রবারও তো এক মহাসন্ধিক্ষণের সামনে হাজির হবে এই ঐতিহাসিক লড়াই। আরও একটি নয়া টুর্নামেন্টে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রবেশ ঘটবে। হোক না কর্পোরেট লিগ, হোক না পেশাদারী মোড়কের ফুটবল, তাতে বাঙালির কিছু যায় আসবে না। সে চাইবে জিতুক দল, জিতুক ফুটবল।
আইএসএলের মহা ধুন্ধুমারের আগে বড় ম্যাচকে তুলে ধরা হল অতীতের নানা ঘটনার সমারোহে। একেকটি ঘটনা যেন একেকটি আলো-আঁধারির কোলাজ। এরকম ১০টি ঘটনা সাজিয়ে দেওয়া হল, যা চিত্তাকর্ষকও।
প্রথম ডার্বি…
মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটেছিল ১৯২১ সালের ৮ আগস্ট, কোচবিহার কাপের সেমিফাইনাল ম্যাচে। ওই খেলাটি ড্র হয়েছিল, কিন্তু রিপ্লে ম্যাচ হয় তার দুইদিন বাদেই, ১০ আগস্ট ওই দিন মোহনবাগান ৩-০ গোলে হারায় ইস্টবেঙ্গলকে, সবুজ মেরুনের গোলদাতা ছিলেন রবি গঙ্গোপাধ্যায়, পল্টু দাশগুপ্ত ও এ ঘোষ।
১০০, ২০০, ৩০০তম ডার্বি ম্যাচে…
১০০তম ডার্বি ম্যাচটি হয় ১৯৬৭ সালের ১৬ ডিসেম্বরে। সেদিন রোভার্স কাপ ফাইনালে ইস্টবেঙ্গল ২-০ গোলে হারিয়েছিল মোহনবাগানকে। ২০০তম ম্যাচটি হয়েছিল এয়ারলাইন্স কাপে ১৯৯৩ সালে, সেই ম্যাচে বাগান টাইব্রেকারে ৬-৫ গোলে হারায় লাল হলুদ বাহিনীকে।
তিনশোতম ডার্বি ম্যাচটি হয় ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি কলকাতা প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে। ওই খেলাটিতে ওডাফা ওকোলি ও মনীশ ভার্গবের গোলে মোহনবাগান ২-০ গোলে হারায় চির প্রতিপক্ষ ক্লাবকে।
ডার্বিতে সবচেয়ে বড় জয়…
এই ঐতিহাসিক ফুটবল দ্বৈরথে সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয় ইস্টবেঙ্গলের। ১৯৭৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আইএফএ শিল্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গল ৫-০ গোলে হারিয়েছিল মোহনবাগানকে, ওই ম্যাচে লাল হলুদের কোচ ছিলেন পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মোহনবাগানের কোচ ছিলেন প্রাক্তন ডিফেন্ডার অরুণ ঘোষ।
ওই ম্যাচে লাল হলুদের হয়ে গোল দিয়েছিলেন শ্যাম থাপা (২টি), রঞ্জিত মুখোপাধ্যায়, সুরজিৎ সেনগুপ্ত ও শুভঙ্কর সান্যাল। ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক ছিলেন অশোকলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
উমাকান্ত পালোধি…
মোহনবাগানের পাঁচ গোলে হারের লজ্জায় আত্মঘাতী হয়েছিলেন সবুজ মেরুনের সমর্থক উমাকান্ত পালোধি। তিনি নিজের সুইসাইড নোটে লিখে গিয়েছিলেন, ‘‘পরের জন্মে এই হারের শোধ নেব মোহনবাগানের ফুটবলার হয়ে জন্মে।’’
তাঁর এই অমোঘ বানী সমর্থকদের কাছে চাপা কান্নার মতো। একজন সমর্থক কতটা হৃদয় দিয়ে ভালবাসলে এমন কথা বলে যেতে পারেন।
ডার্বির কালো দিন…
এখনও বহু ঘরে বয়স্ক অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের মাঠে যেতে দেন না ওই ঘটনার কথা ভেবে। ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট, ইডেন গার্ডেন্সে মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে ঝামেলা, নজিরবিহীন বিতর্ক, তার রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল গ্যালারিতে। তা থেকে মাঠে গণ্ডগোল, সেই সঙ্গে পদপিষ্ট হয়ে মারা যান ১৬টা তাজা প্রাণ।
ওই ঝামেলার মূলে ছিল বিদেশ বসু ও দিলীপ পালিতের একটি সংঘর্ষ, রেফারি সুধীন চট্টোপাধ্যায় দুইজনকেই হলুদ কার্ড দেখান, তারপরে আরও মারামারি হয় মাঠে, সেটি ছড়িয়ে পড়ে গ্যালারিতে। সেই থেকেই অত বড় ঘটনা। আজও আইএফএ ফুটবলপ্রেমী দিবস হিসেবে ১৬ আগস্টে রক্তদান শিবির করে।
সল্টলেক স্টেডিয়াম ও ১ লাখ ৩১ হাজার দর্শক…
এমন ডার্বির রেশ কোনওদিন দেখেনি কলকাতা ময়দান। মোহনবাগানের কোচ অমল দত্ত, তিনি দলকে খেলাচ্ছিলেন ডায়মন্ড সিস্টেমে, ইস্টবেঙ্গলের কোচ সেই পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়। ম্যাচের আগেই বাকযুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল দুটি দল।
১৯৯৭ সালের ১৩ জুলাই যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে দর্শক হয়েছিল ১ লাখ ৩১ হাজার। সল্টলেক স্টেডিয়ামকে মনে হচ্ছিল ব্রাজিলের মারাকানা স্টেডিয়াম। ওই খেলায় বাইচুং ভুটিয়ার হ্যাটট্রিকের সৌজন্যে লাল হলুদ দল ৪-১ গোলে হারায় সেবারের দুরন্ত ফর্মে থাকা বাগানকে। বাকি গোলটি ছিল নাজিমুল হকের, আর মোহনবাগানের হয়ে সান্ত্বনা গোল ছিল চিমা ওকোরির।
প্রথম বিদেশী হ্যাটট্রিক, নজির চিডির…
কলকাতা ডার্বিতে প্রথম বিদেশী ফুটবলারের হ্যাটট্রিক ইডে চিডির, তিনি ২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর কলকাতা লিগের ম্যাচে যুবভারতীতেই ইস্টবেঙ্গলের বিপক্ষে হ্যাটট্রিকসহ করেছিলেন চার গোল, দলও জিতেছিল ৫-৩ গোলে। মোহনবাগানের বাকি গোলটি ছিল মনীশ মাথানির।
ডার্বিতে বেশি গোল বাইচুংয়ের…
কলকাতা ডার্বিতে বেশি গোল বাইচুং ভুটিয়ার, তিনি মোট ১৯টি গোল করেছেন এই মহা ম্যাচে। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে তাঁর গোল সংখ্যা ১৩টি, আর বাকি ছয়টি মোহনবাগানের পক্ষে করেন। বাইচুংয়ের পরেই রয়েছেন যোস রামিরেজ ব্যারেটো, তিনি সবুজ মেরুন জার্সি পরেই করেছিলেন ১৭টি গোল এই ম্যাচে।
বড় ম্যাচে দুই দলের অধিনায়ক…
এমন অভিনব নজির, যেখানে ডার্বিতে দুই দলেরই অধিনায়কত্ব করেছেন। তালিকায় চারজন রয়েছেন, গৌতম সরকার, প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, দুলাল বিশ্বাস ও রেনেডি সিং, শেষজন আবার এই মুহূর্তে ইস্টবেঙ্গলের সহকারী কোচ। তিনি শুক্রবার মাঠে থাকবেন গোয়ায়।
দু’দলের সাক্ষাৎ ও জয়-পরাজয়…
দুটি বড় দল ন্যাশনাল লিগে মোট ৪৫টি ম্যাচে মুখোমুখি হয়, মোহনবাগান জিতেছে ১৫ বার, ইস্টবেঙ্গল দুটি বেশি, ১৭ বার। মোট ১৩ বার ড্র হয়েছে।
দুটি দল শেষ বার সাক্ষাৎ হয় চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি, আই লিগের ওই ম্যাচে মোহনবাগান ২-১ গোলে হারায় ইস্টবেঙ্গলকে, বিজয়ী দলের গোলদাতা ছিলেন জোসেবা বেইতিয়া ও বাবা দিওয়ারা। মার্কোস গোল দিয়েছিলেন লাল হলুদের হয়ে।