
৮০-তে ফুটবল সম্রাট: সেলেকাও আবেগে পেলে কিন্ত দুইয়ে, সেরার মুকুট গ্যারিঞ্চার মাথায়
শুভ্র মুখোপাধ্যায়
চোখের সামনে পেলে দর্শন, এই ঘটনা ঘটেছে দু’বার, একবার কলকাতায় ২০১৫ সালে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। আর প্রথমবার তার আগের বছরই ব্রাজিলের সাও পাওলোর অদূরে স্যান্টোসে। প্রথম দেখার আলাদা আনন্দ, আলাদা শিহরণ।
২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপ কভার করতে গিয়ে পেলের গ্রামেও ঘুরে এসেছিলাম। সেখানে তৈরি হয়েছে তাঁর নামাঙ্কিত জাদুঘর। ওই অনুষ্ঠানে হাজির থাকলেও তিনি সেদিন কোনও কথা বলতে পারেননি, শুধু চোখের জল ফেলেছিলেন। আবেগে তাঁর গলা ধরে এসেছিল। ২৩ অক্টোবর শুক্রবার আজ ফুটবল সম্রাটের ৮০তম জন্মদিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য।
মারাকানার আসল রাজা পেলে নন
মারাকানা যা দিল না ‘ও রেই’কে (রাজা), সেটাই ফিরিয়ে দিল তাঁর নিজের চারণভূমি স্যান্টোস।
রিওর মারাকানায় প্রবেশ করতে গেলে থমকে যেতে হয়। একটা মূর্তি অর্ধেক নির্মিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে সেটি পেলের, কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিল, ফুটবল সম্রাটের মূর্তি বসানো নিয়ে আপত্তি উঠেছিল, তাই কাজ থামিয়ে দিতে হয়েছে। বরং স্টেডিয়ামের গ্রাউন্ড ফ্লোরে জিকোর শট করা তৈল চিত্র আপনার চোখ টানবেই। জিকো নাকি মারাকানার আসল রাজা, পেলে নন। তাই এই সিদ্ধান্ত!
ক্রিকেটে ডন ব্র্যাডম্যানকে বুঝতে গেলে যেমন যেতে হবে বাউরালে, শচীনকে জানতে গেলে যেমন যেতে হবে মুম্বইয়ের শিবাজী পার্কে, তেমনি পেলের ফুটবল পরিধির এক চতুর্থাংশ বুঝতে গেলে যেতে হবে তাঁর গ্রাম স্যান্টোসে। তবে ব্রাজিলীয়দের এই নিয়ে একটা তীব্র আপত্তি রয়েছে। তাঁরা মনে করেন পেলের বেড়ে ওঠার ভূমি স্যান্টোস নয়, ত্রেস কোরাকোসের বাউরু গ্রাম। পেলে এই নিয়ে কিছু বলেননি বলে আলোচনা থামেনি, বরং সেটি তীব্র বিতর্কের মঞ্চ তৈরি করেছে।
পেলের নামে নিজের গ্রামে জাদুঘর
রিওর মূর্তি হয়নি নানা বিরোধিতায়, কিন্তু স্যান্টোসে নিজের গ্রামে পেলের বাসভিটেতে তাঁর নামে জাদুঘর রয়েছে। ব্রাজিল বিশ্বকাপের সময় ওই জাদুঘরের উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন দেশের প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ। এমনকি সেদিন ওই অনুষ্ঠানে ছিলেন ক্রীড়ামন্ত্রী আলদো রেবেলো, যিনি নাকি পেলের জাত সমালোচক। তাঁর কলকাঠিতে মারাকানা স্টেডিয়ামে পেলের মূর্তি পুরোটা হয়নি।
সেদিন দেখেছিলাম, স্যান্টোসে নিজের জাদুঘরের উদ্বোধনে পেলে বেশ আবেগমথিত ছিলেন। তাঁকে চোখের জল ফেলতেও দেখা গিয়েছিল। ওই জাদুঘরও বিশ্বকাপ শুরুর আগেই প্রতিস্থাপনের কথা ছিলো। তাও হলো মাঝপথে।
দিলমা সেদিন বলেছিলেন, ‘‘পেলেই আসল রেই (কিং), তিনি এই সম্মানের যোগ্য লোক।’’ আর পেলেও ওই অনুষ্ঠানে কিছু বলার অবস্থায় ছিলেন না। তাঁকে বারবার চোখের জল মুছতে দেখা গেছে। জানিয়েছেন, ‘‘আমি ১৫বছর বয়সে স্যান্টোসে আসি, তারপর আমার যত নাম ডাক। এখানকার মাটি, এখানকার জল, মানুষগুলো আমাকে ডাকে, নানা সুখানুভূতির পরশ জোগায়। সেই কারণেই ভাবছিলাম, বেঁচে থাকতে এই স্বীকৃতি দেখে যেতে পারবো কিনা। আজ মনে হচ্ছে জীবনে কিছু জিনিস ঠিক করেছিলাম!’’
কী রয়েছে স্যান্টোসের ওই জাদুঘরে?
আয়োজকদের পক্ষ থেকে মার্কোস ডিউজ নামে এক ফুটবলপ্রেমী জানিয়েছিলেন, ‘‘কী নেই বলতে পারেন? পেলের প্রথম গোলের বল থেকে শুরু করে ব্রিটেনের রানির দেওয়া মুকুট, এমনকি স্প্যানিস সংবাদপত্রের একনম্বর লা ইকুইপের অ্যাথলিট অব দ্য সেঞ্চুরির মানপত্র, সবই পাবেন এই জাদুঘরে।’’
ব্রাজিলের এই বন্দর শহরকে বিখ্যাত করে গেছেন পেলে, যিনি ১৭ বছর বয়সে প্রথম বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য ছিলেন। তিনবারের বিশ্বসেরার মুকুট তাঁর মাথায় শোভা পাচ্ছে। সেই অহংবোধ এখনও তাঁকে বিশ্বের নানা প্রান্তে দৌড় করে বেড়ায়!
এখনও ব্রাজিলের সেরা বিজ্ঞাপন
ব্রাজিলের মতো দেশে যেখানে প্রতি মিনিটে একটি করে ফুটবলারের জন্ম হয়, সেই দেশে এখনও পেলেই সেরা বিজ্ঞাপন, সেরা বাস্তবতা। না হলে যেদিন দুবাই থেকে সাও পাওলোর বিমান ধরেছিলাম, তাতে উঠতেই একটি ম্যাগাজিন সব যাত্রীদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল ফ্লাই এমিরেটস কর্তৃপক্ষের তরফে। সেই ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ছিল পেলেরই ছবি। আর ভিতপ্রে ছিল তাঁর একটি বড় সাক্ষাৎকার নিজের দেশে বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে। বহু সাংবাদিককে দেখেছিলাম ওই সাক্ষাৎকারটাই বিভিন্ন ভাষায় তর্জমা করে নিজেদের অফিসে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, যেন মনে হবে প্রথম দিনই কিস্তিমাত করেছেন পেলের সাক্ষাৎকার নিয়ে!
বস্তিতে জন্ম, যেন পাঁকে পদ্মফুল
১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের সাও পাওলো শহরের ট্রেস কোরাকয়েসের এক বস্তিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন পেলে। তাঁর মা-বাবা নাম রেখেছিলেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের সঙ্গে মিল রেখে। পেলের পুরো নাম ‘এডসন অ্যারান্তেস দো নাসিমেন্তো’। অবশ্য বস্তির বন্ধুরা পেলেকে চিনত ‘ডিকো’ নামে।
পাড়ার গলিতে ফুটবল খেলে খুব ছোটতেই দৃষ্টি কাড়েন পেলে। অর্থাভাবে অনুশীলনের জন্য একটি বলও কিনতে পারতেন না তিনি। তাই পুরনো মোজায় খবরের কাগজ মুড়িয়ে ফুটবল বানিয়ে খেলতেন। তাঁর প্রতিভা দেখে চোখে পড়ে যায় সান্তোসের গ্রেট ওয়ালডেমার ডি ব্রিটোর। পেলের জীবনের মোড় ঘুরে যায় তখনই। সেই সময় পেলের বয়স ছিল ১৫ বছর। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় স্যান্টোস ক্লাবে, যোগ দেন ‘বি’ টিমে। সহজাত প্রতিভা দেখিয়ে এক বছরের মধ্যেই মূল দলে নিজের জায়গা করে নেন পেলে। আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
সাফল্য তাঁর পাশে হেঁটেছে সর্বদা
পেলের হাত ধরে ব্রাজিল পেয়েছে অনেক সাফল্য। তিনবার বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন দেশকে। ১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০ সালে পেলের অসাধারণ নৈপুণ্যে ব্রাজিল বিশ্বকাপ জেতে। এ ছাড়া আরও অনেক সাফল্য এনে দিয়েছেন দেশকে। কেরিয়ারে এক হাজার ৩৬৬ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন এক হাজার ২৮৩টি। আর ব্রাজিলের জার্সিতে ৯২ ম্যাচে ৭৭টি গোল করেন তিনি।
জন্মদিনে বিশেষ বার্তা
নিজের ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় পেলে বলেন, ‘‘আমার মনে হয় সৃষ্টিকর্তা আমাকে ভাল স্বাস্থ্য দিয়েছেন, এর জন্য আমি ওঁর কাছে কৃতজ্ঞ। যখন আমি মৃত্যুবরণ করব, তখন সৃষ্টিকর্তা আমাকে একইভাবে স্বাগত জানাবেন। প্রিয় ফুটবলের জন্য আমি সারা বিশ্ব থেকেই প্রশংসা পেয়েছি।’’
একটা কিডনিতেই কাটিয়ে দিলেন পাঁচ দশক
সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবে বিবেচিত পেলে কয়েক বছর ধরে স্বাস্থ্যগত সমস্যায় রয়েছেন। গত বছর কিলিয়ান এমবাপ্পেকে নিয়ে একটি প্রচারের কাজে প্যারিস সফরে গিয়েছিলেন পেলে। কিন্তু কিডনির সমস্যা নিয়ে দ্রুতই হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। পেলের একটি কিডনি রয়েছে। একটি কিডনি কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাঁর কোমরেও সমস্যা রয়েছে। তিনি ওয়াকার ব্যবহার করেন, জনসমক্ষে খুব একটা আসেন না।
২০১৪ সালের শেষ দিকে তাঁর ইউরিনে সংক্রমণ ধরা পড়ে, তারপর থেকেই ডায়ালিসিস চলছে তাঁর। নিয়মিত হাসপাতালেও যেতে হয়। আর কিডনি তিনি হারিয়েছিলেন নিজের ফুটবল জীবনের সায়াহ্নে। একটি ম্যাচে পাঁজরে এত গুরুতর চোট পান যে একটি কিডনি বাদ দিতে হয়েছিল। তাও সেটা প্রায় পাঁচ দশক আগে।
ব্রাজিলে পেলে বাস্তবতা, কিন্তু আবেগ গ্যারিঞ্চা
ব্রাজিলের তরুণ প্রজন্ম পেলে বলতে অজ্ঞান। যেহেতু তিনি এখনও বেঁচে রয়েছেন, সেই কারণে তাঁর প্রতি একটা ভালবাসা, শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু যাঁদের বয়স ৪০-র উপরে তাঁরা পেলের প্রতি ততটা আবেগমুখর নন। বরং তাঁদের মননে বেশি জায়গা করে রয়েছেন গ্যারিঞ্চা। অনেকের ধারণা, দেশ যখন সঙ্কটে, সেই সময় প্রাক্তন ফুটবলার সক্রেটিস পর্যন্ত মুখ খুললেও পেলে নিশ্চুপ ছিলেন। অথচ তিনি তখন দেশের একনম্বর প্রভাবশালী ব্যক্তি। কিন্তু আসল জায়গায় মৌন থেকে তিনি সাধারণের হৃদয় থেকে দূরে সরে গিয়েছেন।
ব্রাজিলে একটি মিথ রয়েছে। সেখানে একবার সমীক্ষা করে দেখা হয়েছিল, কে বেশি জনপ্রিয় ওই দেশে, পেলে না গ্যারিঞ্চা? সমীক্ষা শেষে জানা যায়, পেলেকে জনপ্রিয়তার নিরিখে দশ গোল দিয়েছেন তাঁরই সতীর্থ আরও এক ফুটবল শিল্পী গ্যারিঞ্চা। তার পর থেকেই ব্রাজিলে বলা হয়, গ্যারিঞ্চা উম, পেলে দইস, মানে ‘একে গ্যারিঞ্চা, দুইয়ে পেলে!’