
সানির ক্রিকেট জীবনের হাফসেঞ্চুরি, অমর ৭১’ এর ৫০ বছর
দেবার্ক ভট্টাচার্য্য
১৯৭১ শুধুমাত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার বছর নয়, আরও একটা কারণে অমর হয়ে আছে একাত্তর। কোটি কোটি বাঙালির মতোই সেই বছরই মুম্বইয়ের এক তরুণের স্বপ্নও পূরণ হচ্ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ভারতের জার্সি গায়ে মাঠে নামেন ছোটখাটো চেহারার এক ২১ বছরের ওপেনার। সিরিজের প্রথম টেস্টে চোট থাকায় সুযোগ পাননি। অধিনায়ক অজিত ওয়াদেকার বুঝিয়েছিলেন, সুযোগ আসবে, রান করার জন্য তৈরি থাকো। অধিনায়কের সেই কথাটা নিজের মস্তিষ্কে এভাবে গেঁথে নিয়েছিলেন তিনি যে অভিষেক সিরিজে চার টেস্টে ৭৭৪ রান করেছিলেন তিনি, যা আজও অভিষেক সিরিজে কোনও ক্রিকেটারের করা সর্বোচ্চ রান। ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ যে অধ্যায় শুরু হয়েছিল, শনিবার তার ৫০ বছর পূর্ণ হল। সুনীল মনোহর গাভাসকারের ক্রিকেট জীবনের হাফসেঞ্চুরি হল আজ।
নিজের ক্রিকেট কেরিয়ারে অনেক রেকর্ড করেছেন গাভাসকার। তিনিই ক্রিকেট বিশ্বের প্রথম ব্যাটসম্যান যিনি ১০ হাজার রান করেছিলেন। তিনিই প্রথম যিনি টেস্টে ৩০ সেঞ্চুরি করেছেন। অভিষেক সিরিজে সর্বাধিক ৭৭৪ রান তো রয়েছেই। সেই সিরিজে চারটি সেঞ্চুরি (তার মধ্যে একটি ডবল সেঞ্চুরিও ছিল), দুটি হাফসেঞ্চুরি করেছিলেন। তিনিই একমাত্র ব্যাটসম্যান যাঁর টেস্টের চার ইনিংসেই সেঞ্চুরি রয়েছে।
কিন্তু এগুলো তো শুধুই রেকর্ড। এর পিছনে রয়েছে একটা লড়াই। সেই লড়াই নিজের অদম্য জেদ, ধৈর্য্য ও ফোকাস ধরে রাখার লড়াই। খালি মাথায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্ব ত্রাস বোলিং লাইনআপে থাকা রবার্টস, গার্নার, মার্শাল, হোল্ডিংদের সামলানোর লড়াই। ভারতকে জগত সভায় সেরা আসনে নিয়ে যাওয়ার লড়াই। বিদেশের মাটিতেও ভারতকে জেতানোর লড়াই। আর এই সব লড়াই তিনি জিতেছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, টেকনিকের সঙ্গে ইস্পাত কঠিন মানসিকতা থাকলে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়।
গাভাসকারের প্রথম টেস্টেই ভারত জিতেছিল। আর সেই ম্যাচে দুই ইনিংসেই হাফসেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। সিরিজ জেতার জন্য শেষ টেস্টে ভারতকে ম্যাচ জিততে হত বা ড্র করতে হত। কঠিন সমস্যায় ছিল দল। সেই টেস্টে চতুর্থ ইনিংসে ‘অমর’ ডবল সেঞ্চুরি এসেছিল এই তরুণের ব্যাট থেকে। ক্রিকেট দুনিয়া জেনে গিয়েছিল এক নায়কের জন্ম হয়েছে।
খেলোয়াড় জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে লড়েছেন গাভাসকার। কখনও ফর্মের বিরুদ্ধে। কখনও অধিনায়ক হিসেবে ইডেন টেস্টে কপিল দেবকে দলে না রাখায় সমালোচনার বিরুদ্ধে। কিন্তু সব লড়াইয়ে সামনে থেকে বুক চিতিয়ে লড়েছেন তিনি। ঠিক যেভাবে মাথা লক্ষ্য করে ছুটে আসা বাউন্সারগুলোকে হেলায় সামলেছেন, ঠিক সেভাবেই মাথা উঁচু করে সারা জীবন ক্রিকেট খেলেছেন।
৮৩’র বিশ্বকাপে কপিল দেবের তরুণ ভারতীয় দলে সবথেকে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ছিলেন সানি। তিনি বারবার বলেন তাঁর জীবনের সেরা মুহূর্ত হল বিশ্বকাপ জেতা। তারপরে ভারতের হয়ে ওপেন করা অসংখ্য ব্যাটসম্যান হয়তো তাঁকে দেখেই অণুপ্রাণিত হয়েছেন। শচীন বারবার বলেছেন, তাঁর আইডল গাভাসকার। ৫০ বছর পূর্তিতে টুইট করে শ্রদ্ধাও জানিয়েছেন মাস্টার ব্লাস্টার। গাভাসকারের মতোই শচীনও নিজের কেরিয়ারের সায়াহ্নে এসেই বিশ্বকাপ পেয়েছেন। দুই কিংবদন্তির মধ্যে কী অসম্ভব মিল।
ক্রিকেট ছাড়লেও এখনও কমেন্ট্রিতে সপ্রতিভ ৭২ বছরের সুনীল মনোহর গাভাসকার। বিশেষ করে তাঁর ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণ শোনার জন্য মুখিয়ে থাকেন অগণিত ভারতীয় সমর্থক। সারা জীবন ভারতীয় দলের উন্নতির জন্য ভেবেছেন তিনি। ক্রিকেট ফিল্ডে বরাবর ডাকাবুকো গাভাসকারের মতে ভারতের সবথেকে ভাল টেস্ট দল বর্তমানে বিরাট কোহলির এই দল। শুভমান গিল, ঋষভ পন্থদের ভয়ডরহীন ব্যাটিং এখনও তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ৫০ বছর আগে।
মোতেরায় গাভাসকারকে সম্মানিত করেছে ক্রিকেট বোর্ড। আহমেদাবাদের মাঠেই টেস্টে ১০ হাজার রান করেছিলেন তিনি। আর এই বিশেষ দিনেই হয়তো ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠবে ভারত। সেটাই হয়তো বিরাটদের তরফে গাভাসকারকে দেওয়া সবথেকে বড় সম্মান হতে চলেছে। কারণ ভারতীয় দলের এই লড়াকু মনোভাবের পিছনে নিঃশব্দে একটা নাম থেকে যায়। সুনীল মনোহর গাভাসকার।