
দেবস্মিতা চট্টোপাধ্যায়, বোলপুর: ফাগুন মাস। পলাশের মাস। ভরা ফাগুনে শান্তিনিকেতনের খোয়াই হাটে কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও আবার প্লাস্টিকে ভরে দেদার বিক্রি হচ্ছে পলাশ ফুলের মালা। শান্তিনিকেতনে আসা পর্যটকেরা খোয়াইয়ে বেড়াতে গিয়ে সেই মালা কিনেই গলায়, কপালে, খোঁপায় বাঁধছেন। তারপর চলছে হরেক কিসিমের ফটো সেশন। বসন্ত উৎসবের প্রায় মাসখানেক আগে থেকেই এমন পলাশ নিধন দেখে চোখ কপালে স্থানীয়দের। পলাশ বাঁচাতে কেউ কেউ গাছের গোড়ায় ঝুলিয়েছেন ‘ফুল পারবেন না’, ‘ডাল ভাঙবেন না’ এই জাতীয় নিষেধাজ্ঞা। তবে তাতে শেষরক্ষা হবে কি? ভাবাচ্ছে পরিবেশপ্রেমীদের।
কোপাইয়ের কাঁদোরের ধারে আলো করে ফুটেছে পলাশ। সেখান থেকেই ডাল ভেঙে কিংবা ডাল ছুঁড়ে পলাশ ভাঙছেন অনেকেই। খোয়াই ঘুরলে দেখা যাবে পলাশের মালা যারা বিক্রি করছে তাদের বয়স খুব বেশি হলে ১৫ বছর। ফটো তুলতে দেখলে মুখ ঢাকছে ওড়নায়। কাজটা যে তারা ঠিক করছে না এই বিষয়েও ধারণাও আছে। তবে ওই যে সবাই জানে হাটে নিয়ে গেলেই বিক্রি হবে। কাজেই পলাশ নিধন চলছেই।
পলাশের মালা কিনেছেন কেন? পর্যটকদের কাছে প্রশ্ন করলে তাঁদের সহাস্য উত্তর, “পলাশ কিনতে কোনও নিষেধাজ্ঞা তো চোখে পড়ল না। শান্তিনিকেতনে পলাশ ছেঁড়া যাবে না এমনটাও জানা ছিল না। তাহলে তো শহর জুড়ে ফ্লেক্স, ব্যানারে সেই নির্দেশিকার কথা লিখে রাখতে হবে।” কেউ কেউ বলছেন, “পলাশের ডাল ভেঙে মালা বানিয়েই যখন ফেলেছে, তাতেই তো ফুল যা নষ্ট হওয়ার হয়ে গিয়েছে। কিনতে যখন পাওয়া যাচ্ছে তখন ব্যবহার করতে ক্ষতি কোথায়! বাচ্চারা বিক্রি করে আনন্দ পাচ্ছে সেটাই তো ভাল।”
পর্যটকদের এমন মন্তব্য পলাশ ফুল নিয়ে সচেতনতার অভাব বলেই মনে করছেন শান্তিনিকেতনবাসী। আর এখানেই পলাশ বাঁচাতে প্রশাসনিক তৎপরতা দাবি করেছেন তাঁরা। তবে শুধু প্রশাসন তৎপর হলেই যে এই সমস্যার সমাধান হবে না সেটাও মানছেন সকলে। পর্যটকেরা যদি মালা কেনাই বন্ধ করে দেন, সে ক্ষেত্রে বিক্রির উৎসাহটা হারিয়ে যাবে খুদে বিক্রেতাদের। এভাবেই পলাশ নিধন বন্ধ করা সম্ভব বলে মনে করছেন তাঁরা।
কিছু পর্যটকও অবশ্য স্থানীয়দের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, “বসন্তে আমরা শান্তিনিকেতনে আসি নানা রঙে সেজে ওঠা প্রকৃতি দেখতে। পর্যটকদের মাথায় রাখতে হবে পলাশ ছিড়লে সেই সৌন্দর্যহানি হবে। বাঁকুড়া থেকে আসা এক পর্যটকের কথায়, “আমাদের ওদিকে পলাশ কিছুটা নষ্ট হয় দোলের সময়ে। কিন্তু তার এতদিন আগে থেকে এ ভাবে পলাশ নষ্ট হতে দেখিনি।”
উৎসবের মেজাজে নিজেকে সাজাতে গিয়ে কোনও ভাবেই পলাশ নিধন নয় — সোশ্যাল মিডিয়ায় এই বার্তাও ইতিমধ্যেই অনেক মানুষ দিতে শুরু করেছেন। কিন্তু বাস্তবটা সম্পূর্ণ আলাদা। ফুল বিশেষজ্ঞ সন্দীপকুমার দাস জানালেন, পলাশ গাছ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। বছরে বাড়ে মাত্র এক ফুট। পলাশের বিস্তারও হয় প্রকৃতির আপন খেয়ালে। পলাশের রঙ ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মাঝে প্রকৃতির তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে। তাই পলাশ যদি গাছ থেকে ছিঁড়ে নেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে সেই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে না।”
২০১৭ সাল থেকে বসন্ত উৎসবে পলাশ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিশ্বভারতী। কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, এর ফলে অনেকটাই কমানো গেছে ফুলের ব্যবহার। তবে বাইরে অনেকেই বিক্রি করেন মালা, কেনেনও অনেকে। পলাশ ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করতে গাছ পাহারা দিতে হবে তাহলে। এমনটাও ভাবছেন স্থানীয়রা। শ্যামবাটির একটি পলাশ গাছকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখেন ব্যবসায়ীরা। ছবি তোলা পর্যন্ত ছাড় আছে। কিন্তু গাছে হাত দিতে গেলেই নিষেধ করেন তাঁরা। পলাশ বাঁচানোর উদ্যোগ চলছে এভাবেই। তবে বাঁচবে কি? সেই প্রশ্নটাও ঘুরছে।