
হাতে বই আর চক, সৌরবাতির আলোয় ছোটদের স্বপ্ন দেখাচ্ছে বছর পনেরোর দিদিমনি অমিতা শবর
অন্ধকার গাঢ় হলেই জ্বলে ওঠে রাস্তার ধারে বন দফতরের দেওয়া সৌরবাতি। তখনই গুটিগুটি পায়ে বই পেন্সিল নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে খুদেদের দল। সৌরবাতির আলোর নীচে তখন তাদের অপেক্ষায় পাঠশালা সাজিয়ে বসেছে তাদের অমিতা দিদিমনি।
দ্য ওয়াল ব্যুরো, পুরুলিয়া: একদিকে রাইকা পাহাড় । আরেকদিকে বেলডুংরি পাহাড় । দুই পাহাড়ের কোলে একেবারে ছোট্ট এক জনপদ। বান্দোয়ান থানার কেতকি। শবর পাড়া নামেই যার পরিচিতি।
শীতের সন্ধ্যা নামে দ্রুত। রাস্তার দু’পাশ ধরে ছোট ছোট ঘর। অভাব-অনটন আর দারিদ্রকে সেখানে চিনিয়ে দিতে হবে না আলাদা করে। অন্ধকার গাঢ় হলেই জ্বলে ওঠে রাস্তার ধারে বন দফতরের দেওয়া সৌরবাতি। তখনই গুটিগুটি পায়ে বই পেন্সিল নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে খুদেদের দল। সৌরবাতির আলোর নীচে তখন তাদের অপেক্ষায় পাঠশালা সাজিয়ে বসেছে তাদের অমিতা দিদিমনি।
বছর পনেরোর অমিতা দিদিমনি নিজেও স্কুলের ছাত্রী। ক্লাস নাইনের। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি পথ বাতির আলোয় শবর শিশুদের নতুন আলোর সন্ধান দিচ্ছে অমিতা শবর। সৌরবাতির আলোয় ওই কিশোরী পড়াশোনা শেখাচ্ছে এলাকার শিশুদের। তাই সন্ধেও নামলেই গুটি গুটি বইখাতা নিয়ে তারা চলে আসে তাদের দিদিমনির কাছে। অমিতার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে বান্দোয়ান ব্লক প্রশাসনও।
ব্রিটিশ যুগের তকমা – শবর মানেই অসামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। অভিমানে, দুঃখেই হয়তো শবর জনজাতির মানুষরা সভ্য জগত থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে রাখতেই ভালোবাসতো। প্রশাসনের ধারাবাহিক চেষ্টার ফলে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। সেই বদলানোর উদাহরণ অমিতা। বান্দোয়ান গার্লস স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রী অমিতা হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। লকডাউনের সময় সকলের মত সেও বাড়ি ফিরে এসেছিল। ফিরে আসার পর দেখে পাড়ার শিশুরা পড়াশোনার জগৎ থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছে। কেউ নিয়মিত পড়াশোনা করে না । চিন্তাটা হঠাৎই তার মাথায় খেলেছিল তখন। বাড়ির সামনেই বন দফতরের দেওয়া সৌরবাতি। বেশ কিছুটা জায়গা ফাঁকাও আছে। সেখানেই সে বসিয়েছে তার পাঠশালা ।
প্রথমদিকে ব্ল্যাকবোর্ড ছিল না। লাগোয়া একটি ঘরের ভাঙা দরজাটাই ব্যবহার করেছিল বোর্ড হিসেবে। কোনও একসময় বাবা রং করার জন্য এনেছিল খড়িমাটি। সেই খড়িমাটি দিয়ে দরজার ওপর লিখত অ আ ই ঈ কিংবা এ বি সি ডি। লকডাউন এর সময় থেকেই এলাকার সমস্ত শিশুদের নিয়ে সে সান্ধ্যকালীন পাঠশালা শুরু করে। অনেক ছোটতে মা মারা গিয়েছে। সারাদিন ঘরের সমস্ত কাজ ও নিজের পড়াশোনা করার পর সন্ধ্যা নামলে শুরু হয় তার পাঠশালা। অমিতা জানাল, ‘‘প্রথম কয়েকদিন ডেকে খুঁজে পড়ানোর জন্য নিয়ে আসতে হত ওঁদের। এখন আর কাউকে ডাকতে হয় না। সন্ধ্যার অন্ধকার নামলে বাচ্চারাই হাজির হয়ে যায়। আমি যতটা জানি তাই পড়ানোর চেষ্টা করি ওদের।’’
শবর জনজাতির মানুষরা ভীষণ রকম ভাবে নেশায় অভ্যস্ত। সারাদিনই প্রায় নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকেন। সেই অবস্থার পরিবর্তনের জন্যও কোমড় বেঁধে নেমেছে অমিতা। এলাকার সবাইকে বুঝিয়েছে নেশা করার অপকারিতা। তারপর তার ফরমান দিনের বেলায় কোনও নেশা করা যাবে না। প্রতিবেশীরাও সাধুবাদ জানিয়েছে অমিতার এই উদ্যোগকে। স্থানীয় বাসিন্দা অনিল শবর বলেন, ‘‘অমিতার জন্য অনেকেই নেশা করা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে কমিয়ে দিয়েছেন নেশা করা। আলোর দিশারী অমিতার পাশে দাঁড়িয়েছে এলাকার মানুষজন।’’
বান্দোয়ান ব্লক প্রশাসনেরও নজরে এসেছে অমিতা শবরের এই পাঠশালা। বছর পনেরোর এই কিশোরীর পাশে দাঁড়িয়েছে ব্লক প্রশাসন। বান্দোয়ানের বিডিও কাসিফ সাবির বলেন, ‘‘এই কিশোরী যেভাবে একার উদ্যোগে এলাকায় ছোটদের পড়াশোনা শেখানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন তাকে কুর্নিস জানাচ্ছি আমরা। ওকে সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি আমরা।’’
ইতিমধ্যেই আলোর ব্যবস্থা করে দেওয়ার পাশাপাশি ব্লক প্রশাসনের তরফে অমিতাকে দেওয়া হয়েছে নতুন ব্ল্যাকবোর্ড।