
মুখ্যমন্ত্রীর সফরের পরেই খোয়াইয়ের কোলে রঙে-নকশায় সেজে উঠছে বল্লভপুর, পর্যটকদের ভিড় হল বলে!
গ্রাম সেজে উঠছে বলে খুব খুশি বল্লভপুরডাঙার বাসিন্দারা। নিজের ঘর, এলাকা সাজলে কার না ভাল লাগে। কিন্তু, ওঁদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এল নানা আশা-আশঙ্কার কথাও। কেউ কেউ ভয় পাচ্ছেন, যে হারে খোয়াই হাটে ভিড় হয় সেই পরিমাণ মানুষ এবং যানবাহন যদি গ্রামের মধ্যে ঢুকতে শুরু করে সেক্ষেত্রে গ্রামের খুদেরা যতটা সহজ সরলভাবে রাস্তাঘাটে খেলাধুলো করে সেটা সম্ভব হবে না।
দেবস্মিতা চট্টোপাধ্যায়, বোলপুর: নিকানো মাটির দেওয়াল রাঙানো হয়েছে নানা রঙ-নকশা, ফুল, পাখি আর গাছপালায়। শোভা পাচ্ছে বর্ণমালা নিয়ে ছড়া। ঝকঝকে নতুন কলতলায় শুদ্ধ পানীয় জলের হাতছানি। খোয়াইয়ের কোলে সেজে উঠছে আদিবাসী গ্রাম বল্লভপুরডাঙা।
শান্তিনিকেতনের শ্যামবাটি পিছনে রেখে খোয়াই বনের অন্য হাট পেরিয়ে আমার কুটিরের রাস্তা ধরে এগিয়ে ডানদিকে গেলে পড়বে এই গ্রাম। হঠাৎ এসে পড়লে গ্রামের একের পর এক বাড়ির ছবি আঁকা দেওয়াল দেখে পটে আঁকা কোনও ছবির গ্রাম বলেও ভুল হতে পারে। ছবির বিষয় পরিবেশ সচেতনতা। সেই বার্তা থাকবে অলচিকি লিপিতেও। প্রশাসনের ভাবনা হল, এর মধ্যে দিয়ে একদিকে যেমন অলচিকির প্রসার বাড়বে, অন্যদিকে আদিবাসী পরিবারের সন্তানরা ছোট থেকেই দেওয়ালে তাদের মাতৃভাষার লিপি চিনে বড় হবে।

বোলপুর-শ্রীনিকেতন ব্লকের ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক শেখর সাঁইয়ের কথায়, “বল্লভপুরডাঙা গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির দেওয়ালে অলচিকি ভাষায় পরিবেশ সচেতনতার বার্তা লেখার ব্যাপারে ইতিমধ্যেই জেলাশাসকের সঙ্গে কথা হয়েছে। আপাতত বার্তাগুলি বাংলায় লেখা হলেও আগামীতে থাকবে অলচিকিও।”
গত ৩০ ডিসেম্বর জেলাসফর সেরে বোলপুর থেকে কলকাতা ফেরার পথে আচমকা বল্লভপুরডাঙা গ্রাম পরিদর্শনে যান রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হঠাৎ করে তাঁকে কাছে পেয়ে কোন নেই রাজ্যে তাঁদের বাস, সে কথা জানান এখানকার গ্রামবাসীরা। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে তড়িঘড়ি শুরু হয় ব্যবস্থাপনা। এর পরেই একে একে হয়েছে বিদ্যুতের ব্যবস্থা, জলের ব্যবস্থা, শৌচালয়। বাড়ি থেকে বড় ড্রেন পেরিয়ে যাতে সহজেই রাস্তায় আসা যায় তার ব্যবস্থাও করা হয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ শেষ করার চেষ্টা করছে প্রশাসন। শুধুমাত্র সরকারি পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া নয়, একইসঙ্গে ঢেলে সাজানো হচ্ছে গ্রাম। আগামীতে খুব সহজেই পর্যটকদের টানবে এই গ্রাম, এমনটাও আশা রাখছেন প্রশাসনিক কর্তারা।
গ্রাম সেজে উঠছে বলে খুব খুশি বল্লভপুরডাঙার বাসিন্দারা। নিজের ঘর, এলাকা সাজলে কার না ভাল লাগে। কিন্তু, ওঁদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এল নানা আশা-আশঙ্কার কথাও। কেউ কেউ ভয় পাচ্ছেন, যে হারে খোয়াই হাটে ভিড় হয় সেই পরিমাণ মানুষ এবং যানবাহন যদি গ্রামের মধ্যে ঢুকতে শুরু করে সেক্ষেত্রে গ্রামের খুদেরা যতটা সহজ সরলভাবে রাস্তাঘাটে খেলাধুলো করে সেটা সম্ভব হবে না। এত দিন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে খেলায় বিপদের সেই ঝুঁকি ছিল না। কারও কারও আবার আশঙ্কা, স্মার্টফোনের যুগে তাঁদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই হয়তো ছবি তুলতে শুরু করবেন কোনও কোনও পর্যটক তখন কী হবে! শান্তি থাকবে তো?
তাঁদের এমন ভাবনার কথা প্রশাসনের কানেও পৌঁছেছে। প্রশাসনিক কর্তারা জানাচ্ছেন, শান্তিনিকেতনের এই এলাকা এমনিতেই পর্যটনক্ষেত্র হিসেবে প্রসিদ্ধ। নতুন করে সাজানোর ফলে বল্লভপুরডাঙা গ্রাম যদি পর্যটকদের টানে তা গ্রামের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করবে। আর গ্রামবাসীদের আশঙ্কার কথা প্রসঙ্গে তাঁরা জানাচ্ছেন, এমন হলে প্রশাসনকে জানাতে হবে আর নিজেদেরও সতর্ক থাকতে হবে। গ্রামের পাশের বড় মাঠে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা নিয়েও চিন্তাভাবনা শুরু হচ্ছে। এলাকার লোকজনও এখন চাইছেন, গাড়ি পার্কিং করে পায়ে হেঁটে গ্রাম দেখুন পর্যটকেরা। তাহলেই সমস্যা কমবে।
এত আড়ম্বরের মাঝে যেন প্রয়োজনটুকু হারিয়ে না যায় সে এমন কথাও মনে হয়েছে গ্রামের কিছু শিক্ষিত তরুণ তরুণীর। তাঁরা বলছেন, ‘‘গ্রাম সাজুক, পর্যটক আসুক ক্ষতি নেই। এর পাশাপাশি ভাল করে পড়াশোনার পরিকাঠামো করে দেওয়ার দিকেও নজর দিক প্রশাসন। তবেই সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব।’’
তা হলে কি শান্তিনিকেতনের মতো আন্তর্জাতিক এই পর্যটনক্ষেত্রে আরও একটা জায়গায় নাম দ্রষ্টব্য হিসেবে উঠে আসছে! নাম তার বল্লভপুরডাঙা?