
দ্য ওয়াল ব্যুরো: এত বড় বাক্স এর আগে কোনওদিন দেখেনি বিট্টু। এতজন লোক এর আগে তার বাড়িতে আসেনি কখনও। মুখ চেপে কেঁদেই চলেছেন দিদিয়া। মা-কেও দু’দিন ধরে ভালোমতো দেখতে পায়নি সে। কোথাও একটা বড়সড় গোলমাল হয়েছে৷ চার বছরের চোখে স্রেফ এতটুকুই সন্দেহ করেছিল বিট্টু।
বাবার তো আজকেই ফিরে আসার কথা ছিল, আসেনি কেন? অজানা আশঙ্কায় বারবার সবাইকে একই কথা জিজ্ঞেস করে চলেছিল সে। আর্মির পোশাক গায়ে চড়িয়ে বেশ ক’দিন আগেই ঘর ছেড়েছিল বাবা। চার দিন হতে চলল, কোনও ফোন নেই কেন? একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরেছিল তাকে।
তারপরই বুধবারের সকাল। ঘুমও ঠিকমতো ভাঙেনি। বাইরে লোকজনের আওয়াজ, চাপা কান্না শুনে বেরিয়ে আসে বিট্টু। বাইরে লোকজনের ভিড়। কে নেই সেখানে! পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন, চেনা-অচেনা মানুষদের জনস্রোত বইছে যেন। সবার মুখে তার বাবারই নাম… ‘রমেশ কুমার জুরি অমর রহে’ — হাত মুঠো করে আকাশে নিক্ষেপ করছিল সেনাবাহিনীর কম্যান্ডোরা। ঠিক তখনই বাড়ির বাইরে রাস্তার মুখে ওই প্রকাণ্ড বাক্সটা তার নজরে আসে। ত্রিবর্ণরঞ্জিত ভারতের পতাকা দিয়ে মোড়ানো। উপরের ফুল আর মালার পাহাড়!
ডিআরজি রমেশ কুমার জুরি। শনিবার বস্তারের জঙ্গলে মাওবাদী সংঘর্ষে প্রাণ হারান তিনি৷ তাঁরই বছর চারেকের ছেলে বিট্টু। বুধবারের সকাল ঠিক এভাবেই তার চোখের সামনে আড় ভেঙে ওঠে। বিট্টু জানে না, তার বাবা কোথায়৷ বিট্টু জানত না, ওই বড়, সুদৃশ্য বাক্সে কী রয়েছে। কোলাহল-মুখরিত জনতার আবেগ, বিষাদ, হতাশা আর যন্ত্রণাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল একরত্তি ছেলেটার একটা সহজ এবং সরল প্রশ্ন — ‘এর ভেতরে কী আছে?’
শনিবার মাওবাদী হানায় কেঁপে উঠেছিল বিজাপুর-বস্তার লাগোয়া জঙ্গলমহল। টানা পাঁচ ঘণ্টার এনকাউন্টার। অতর্কিত মাও হামলা। যার জেরে প্রাণ হারান ২২ জন জওয়ান।
তারপর দেশের উচ্চস্তর থেকে সমবেদনা এবং প্রতিরোধের বার্তা আসে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিহত এবং আহতদের পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। এর মধ্যে কেটে গিয়েছে চার দিন। কিন্তু শোকের ক্ষত শুকোনোর বদলে, তা যেন কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। কারণ, এর মধ্যে সেনার তরফে আহত জওয়ানদের মৃতদেহ দেশের নানা প্রান্তে পাঠানোর কাজ শুরু হয়েছে।
বুধবার কঙ্করের পান্দ্রিপানি গ্রামে ছিল শোকের আবহ৷ শহীদ ডিআরজি রমেশ কুমার জুরির বাড়ি এখানেই। এদিন সকালে তাঁর কফিনবন্দি দেহ এসে পৌঁছোয়৷ যন্ত্রণায় দিশেহারা রমেশের মা বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন।
কোন্দাগাঁওয়ের বানজুগতির ছবিটাও ঠিক এরকম। শহীদ কনস্টেবল সুখারাম সিং বানজুগতিরই ভূমিপুত্র৷ সুখারামের স্ত্রী পরমশীলা স্বামীর মৃতদেহ দেখেও পাগলের মতো ভগবানের কাছে আর্তি জানিয়ে চলেছেন, যাতে সবই ভুল হয়ে যায়। দুঃস্বপ্নের যন্ত্রণা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে চাইছেন না পরমশীলা।
বরফের মতো শীতল-কঠিন চোখে ছেলের সৎকার দেখছিলেন ফাগুরাম। কোলে এক বছরের নাতি… সুখারামের ছেলে। চাপা, জড়ানো গলায় ফাগুরাম বলেন, ‘জানি না, বউমাকে কীভাবে মুখ দেখাব৷ খবরটা শোনার পর থেকেই বারবার জ্ঞান হারাচ্ছে মেয়েটা।’
মাটির অন্ধকার দুনিয়ায় ততক্ষণে শুয়ে রয়েছেন সুখারাম। আপাতত বিশ্রাম… চিরজীবনের মতো। চোখের জল ফেলতে ফেলতে অস্পষ্ট স্বরে ফাগুরাম বলেন, ‘ছেলের জন্য গর্বিত আমি। ওর আত্মত্যাগ বৃথা যাবে না।’