
এবার কিন্তু জল নাকের ওপরে উঠে আসছে।
দিশা রবি নামে বেঙ্গালুরুর এক তরুণীকে গত রবিবার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে এনেছে দিল্লি পুলিশ। অভিযোগ, তিনি ভয়ংকর দেশবিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত। তাঁর সঙ্গে খলিস্তানি উগ্রপন্থীদের যোগ আছে। তাদের উস্কানিতে দিশা দিল্লির কৃষক আন্দোলনের কথা আন্তর্জাতিক মহলে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তাতে ভারতের সম্মানহানি হয়েছে।
এক তরুণী কী একটা লিখলেন আর অমনি ভারতের সম্মানহানি হয়ে গেল? ভারতের সম্মান কি এতই ঠুনকো?
দিশা ও তার কয়েকজন বন্ধু একটা টুলকিট তৈরি করেছিলেন।
টুলকিট জিনিসটা কী?
বলতে গেলে এটা হল এক ধরনের ডিজিটাল ইস্তেহার। যে কোনও আন্দোলনের সময় সংগঠকরা ইস্তেহার প্রকাশ করেন। তাতে আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা সম্পর্কে লেখা থাকে। এমনিতে ইস্তেহার হাতে হাতে বিলি হয়। কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যমে ইস্তেহার প্রকাশ করলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে বিশ্বজুড়ে।
২০১১ সালে আমেরিকায় ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের সময় সম্ভবত প্রথমবার টুলকিট ব্যবহৃত হয়। ২০১৯ সালে হংকং-এ যখন চিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন হয়েছিল তখনও ছেলেমেয়েরা বানিয়েছিল টুলকিট।
দিশারা যে টুলকিট বানিয়েছিলেন তাতে বলা হয়েছিল, কীভাবে দিল্লির কৃষক আন্দোলনকে সাহায্য করা যেতে পারে। দিল্লি পুলিশ বলছে, ওই টুলকিট ২৬ জানুয়ারি রাজধানীতে হিংসা ছড়িয়ে পড়ার জন্য অনেকাংশে দায়ী।
ঠিক কীভাবে ওই টুলকিটে হিংসায় উস্কানি দেওয়া হয়েছিল?
সেটা এখনও ঠিক জানা যায়নি।
দিশা রবি সম্পর্কে আপাতত যেটুকু জানা গিয়েছে, তা হল, তাঁর বয়স ২১ বছর। তিনি বেঙ্গালুরুর মাউন্ট কারমেল কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন। তাঁর ধারণা, বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলির আগ্রাসনে বিশ্বজুড়ে বাস্তুতন্ত্র বিপন্ন হয়ে উঠেছে। শীঘ্র তাদের থামাতে না পারলে একদিন মানবজাতির অস্তিত্বই মুছে যাবে। সেই ধারণা তিনি জোরের সঙ্গে প্রচার করতেও কুণ্ঠিত নন।
২০১৮ সালে পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ ‘ফ্রাইডেস ফর ফিউচার’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। শুরু থেকেই দিশা তার সক্রিয় সদস্য। ২০১৯ সালে তাঁরই উদ্যোগে ভারতে ওই সংগঠনের শাখা খোলা হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে পরিবেশকর্মীদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখেন। তাঁদের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করেন।
বিজেপি বলছে, দিশার মতো মেয়ের জন্যই নানা দেশে ভারত সরকারের বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠছে। বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মন্তব্য করছেন।
একথার কোনও মানে হয় না। এই বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে তা কি কারও অজানা থাকে? দিশার মতো মেয়েরা প্রচার না করলেও সবাই কৃষক আন্দোলনের কথা জানতে পারত। শুধু তাই নয়, মন্তব্যও করত। লোকের মুখ বন্ধ করা যাবে কী করে? আমাদের দেশের অনেকেও তো বিদেশের ব্যাপার নিয়ে মন্তব্য করেন। আমেরিকার ক্যাপিটল হিলে যখন ট্রাম্প ভক্তরা হামলা করেছিল তখন নরেন্দ্র মোদী কি মন্তব্য করেননি?
বিদেশিরা যদি ভারতের ব্যাপারে ভুল বলেন, দেশের মানুষই প্রতিবাদ করবে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ত্রুডো যখন কৃষক আন্দোলন নিয়ে সরব হয়েছিলেন, ভারতের মানুষ তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিল, আপনিই তো ডব্লুটিও-তে কৃষিতে ভরতুকি তুলে দেওয়ার জন্য সওয়াল করেছিলেন।
তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে গত ৮০ দিনের বেশি সময় ধরে আন্দোলন চলছে। সরকার কিছুতেই সামলাতে পারছে না। হতাশা থেকে মানুষ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চায়। মনে রাখতে হবে, আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রতিহিংসা নেওয়ার মানসিকতা ব্যাপকভাবে কাজ করে। আমাদের এখানে ফেসবুকে রাজ্য সরকারকে নিয়ে মজা করার জন্য অম্বিকেশ মহাপাত্রকে জেলে যেতে হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহ আঞ্চলিক রাজনীতি থেকেই উঠে এসেছেন। বাজপেয়ী আমলেও তো সরকারের বিরুদ্ধে কত লোক সমালোচনা করত। তখন সরকারের এরকম প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব দেখা যায়নি। মনমোহন সিং সরকারের আমলে দিল্লিতে আন্না হাজারে আন্দোলন করেছিলেন। তখনও পুলিশ বেপরোয়া ধরপাকড় করেনি।
অনেকেই বলছেন, জরুরি অবস্থার সময় পুলিশ যেভাবে বিরোধীদের ধরে ধরে জেলে পুরে দিত, মোদী জমানায় ফের সেইরকম শুরু হয়েছে। কথাটা একেবারে অস্বীকার করা যায় না। ১৯৭৫ থেকে ‘৭৭ সালের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধীর পুলিশও অনেককে দেশদ্রোহী বলে জেলে পুরে দিয়েছিল। তাঁদের অন্যতম হলেন জর্জ ফার্নান্ডেজ। তিনি তখন শ্রমিকনেতা ছিলেন। পরে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি নিশ্চয় দেশদ্রোহী ছিলেন না।
বিরোধীরা বলছেন, পুলিশ এখন যাদের বিরুদ্ধে সিডিশানের চার্জ আনছে, তাঁরাও সকলে দেশদ্রোহী নন।
‘৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি করার একটা কারণ ছিল। তার আগে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয়েছিল অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। গুজরাতে, বিহারে ছাত্র আন্দোলন দমন করার জন্য মিলিটারি নামাতে হয়েছিল। ‘৭৪ সালে দেশ জুড়ে রেল ধর্মঘট হয়েছিল। সেই ধর্মঘট আদৌ শান্তিপূর্ণ থাকেনি। এই পরিস্থিতিতে পুলিশের বাড়াবাড়ির তবু একটা কারণ থাকতে পারে। কিন্তু এখন তো অত খারাপ অবস্থা হয়নি। ২৬ জানুয়ারির দিনটা বাদ দিলে বলা যায়, কৃষক আন্দোলন মোটামুটি শান্তিপূর্ণই আছে।
কোথাও আন্দোলন হলে সেই দেশের বদনাম হয় না। বরং বিদেশের মানুষ বুঝতে পারে, সেখানে গণতন্ত্র আছে। তাই মানুষ নির্ভয়ে সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পারছে।
কিন্তু পুলিশ যদি যাকে তাকে দেশদ্রোহী বলে স্ট্যাম্প মারতে থাকে, বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসে, তাহলেই দেশের বদনাম হবে।