
শঙ্খদীপ দাস
এবার পুজোর পর থেকেই বেশ আলোচনায় রয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। রাজ্য রাজনীতি এবং তার বাইরেও বাংলার বহু মানুষ তাঁকে নিয়ে হরেক কিসিমের জল্পনায় মজে রয়েছেন।
কী বলছেন তাঁরা? বেশিরভাগই মনে করছেন শুভেন্দু তৃণমূল ছেড়ে দেবেন। স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। কেন ছাড়বেন? কারণ, উনি দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের উপরে চটে রয়েছেন। এ সব সাত সতরো আলোচনা করতে করতেই শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর মন্ত্রিসভা ও সমস্ত রকম সরকারি পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন শুভেন্দু। এমনকি সরকারি নিরাপত্তা, পুলিশি পাইলটও ছেড়ে দিয়েছেন। এক কথায় ঝাড়া হাত পা!
কিন্তু কেন এই পদত্যাগ?
‘রেগে রয়েছেন’ বা ‘অসন্তুষ্ট’—এগুলো একেবারেই ওপর ওপর কথা হয়ে গেল। সুপারফিশিয়াল। রাগের কারণ কী?
এ কথা বলতে গিয়ে একটা পুরনো ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। ১৯৭০ সালের ১৬ মার্চ। তখন অবশ্য আমার জন্মও হয়নি। সবটাই শোনা কথা। প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে শোনা। ওই দিন মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। তার পর বাংলার সবকটি জেলা ঘুরে ঘুরে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, কেন ইস্তফা দিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে ৬৬টি সভা করেছিলেন অজয়বাবু। তার পর সেই বক্তৃতার সংকলন করে একটি পুস্তিকাও প্রকাশ হয়েছিল— “কেন এই পদত্যাগ?” প্রণববাবু সেই পুস্তিকাটি আমাকে পড়তেও দিয়েছিলেন। (কারও যদি বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ থাকে, তা হলে সেই পুস্তিকাটির প্রতিপাদ্য হুবহু নিচে দেওয়া রইল)।
শুভেন্দুর সে রকম কোনও অভিপ্রায় রয়েছে কিনা জানি না। তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে আগামী দিনগুলোয় বাংলার বিভিন্ন জেলা তিনি নিশ্চয়ই ঘুরবেন, বক্তৃতা দেবেন, মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন। পদত্যাগের কারণও হয়তো তখন ব্যাখ্যা করবেন এই দাপুটে নেতা।
আপাতত তৃণমূলে শুভেন্দুর খুব কাছের কিছু নেতা, তাঁর ঘনিষ্ঠ লোকজন এবং ‘দাদার অনুগামীদের’ সঙ্গে কথা বলে পরিষ্কার ভাবে যা বোঝা যাচ্ছে তাতে পদত্যাগের কারণগুলো মোটামুটি ভাবে এই রকম:
তাঁদের কথা খুব স্পষ্ট। তা হল, শুভেন্দুর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আস্থার সম্পর্ক অনেক বছর ধরেই নেই। যা ছিল, তা স্রেফ কাজের সম্পর্ক। ওয়ার্কিং অ্যাডজাস্টমেন্ট। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাজ করতে দিয়েছেন। শুভেন্দু কাজ করে দিয়েছেন। এবং তা খুব নিষ্ঠার সঙ্গেই করেছেন। জেলাওয়াড়ি সমস্ত জেলার পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু মাওবাদীদের হুমকি পরোয়া না করে শুভেন্দু অতীতে রীতিমতো ঝুঁকি নিয়ে যে ভাবে জঙ্গলমহলের জেলাগুলোয় সংগঠন বাড়িয়েছেন, বা পরে মুর্শিদাবাদ, মালদা, উত্তর দিনাজপুরে সংগঠনের কাজ করেছেন, তা আর কোনও পর্যবেক্ষককে করতে দেখা গিয়েছে কি?
তার পরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুভেন্দুকে বিশ্বাস করতেন না বলেই তাঁদের অনুযোগ।
তাঁর ঘনিষ্ঠদের আরও বক্তব্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইনার সার্কেলে’ শুভেন্দু কোনওদিন ছিলেন না। অর্থাৎ শোভন চট্টোপাধ্যায়, অরূপ বিশ্বাস, ফিরহাদ হাকিমদের মতো দক্ষিণ কলকাতার নেতা মন্ত্রীদের নিয়ে যতটা আহ্লাদ-আদিখ্যেতা হয়েছে তা শুভেন্দুকে নিয়ে কখনওই হয়নি। তা ছাড়া ষোলো সালে ভোটের পর তাঁকে পরিবহণ মন্ত্রী করা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দেওয়াও হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী অর্থ দফতরকে দিয়ে সার্কুলার বের করে সময়ে সময়ে পরিবহণ দফতরের কাজ করিয়েছেন।
আর শেষমেশ কফিনে পেরেক পোঁতার মতো ঘটনা ঘটেছে, এ বছর ২৩ জুলাই। শুভেন্দু ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, দলে পর্যবেক্ষক পদটাই তুলে দেওয়া হয়েছে। কার পরামর্শে, কে কলকাঠি নেড়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুভেন্দুর ডানা ছাঁটার জন্যই তা করা হয়েছে। এর পর আর বিশ্বাসের সম্পর্কের বাকি কি রইল?
তাঁদের মতে, গোড়ার দিকে কিন্তু কোনও সমস্যা ছিল না। ২০১১ সালের ২১ জুলাই পর্যন্ত সব ভালই ছিল। অনেক অল্প বয়স থেকে রাজনীতি করছেন শুভেন্দু। রাজ্য রাজনীতির বড় মাঠে ভাল করে মানুষ তাঁকে চিনতে শুরু করে ২০০৭ সাল থেকে। কারণ, নন্দীগ্রামে রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। শুভেন্দুই ছিলেন সেই গণ আন্দোলনের নায়ক। ফলে শুধু রাজ্য রাজনীতি নয়, জাতীয় স্তরেও মানুষ তখনই চিনেছিলেন তরুণ শুভেন্দুকে। কেন না সেই সময়ে নন্দীগ্রাম আন্দোলন নিয়ে তুমুল চর্চা হয়েছিল জাতীয় রাজনীতিতেও।
স্বাভাবিক ভাবেই সিপিএম তথা বাম সরকার বিরোধী সেই গণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বাংলাজুড়ে শুভেন্দুর জনপ্রিয়তাও বাড়তে শুরু করেছিল। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশের কাছে শুভেন্দু বাম বিরোধী আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছিলেন। কিছুটা অনিবার্য ভাবেই ২০০৮ সালে তাঁকে দলের যুব সভাপতি করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
শুভেন্দু ঘনিষ্ঠদের মতে, আস্থার সম্পর্কে প্রথম ফাটল ধরা শুরু হয় ২০১১ সালের ২১ জুলাই। রাজ্যে ক্ষমতা পরিবর্তনের ঠিক পর পরই। সে দিন শুভেন্দুকে এক প্রকার অন্ধকারে রেখে তৃণমূলে নতুন একটি শাখা সংগঠনের নাম ঘোষণা করা হয়—‘তৃণমূল যুবা’। যার নেতৃত্ব দেবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের যুব সংগঠন রয়েছে, তার সমান্তরালে যুবা নামে একটি সংগঠন তৈরি করে দেওয়ার উদ্দেশ্য কী বুঝতে বাকি থাকে না।
পরে ২০১৪ সালে দলের যুব সভাপতি পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয় শুভেন্দুকে। তমলুক লোকসভা কেন্দ্র থেকে আড়াই লক্ষেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে সে বার জিতেছিলেন শুভেন্দু। তার পরেও। কাকে সেই পদে আনা হয়? সৌমিত্র খাঁ-কে। যিনি এখন বিষ্ণুপুরের বিজেপি সাংসদ। সেই সময়ে শুভেন্দু-সৌমিত্রর মধ্যে তুল্যমূল্য বিচারে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দক্ষতায় কে বেশি যোগ্য ছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনও নয় যে শুভেন্দুর তখন চুল পেকে গিয়েছিল। বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন। যুব সভাপতি পদে আর মানাচ্ছিলেন না। তাঁর ঘনিষ্ঠদের কথায়, অচিরেই সৌমিত্র খাঁকে সরিয়ে যুব সভাপতি করা হয় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। রদবদলের কার্যকারণ এতদিনে সাদা-কালোয় পরিষ্কার হয়ে যায়। এবং তার পর থেকে মূলত দিদি আর শুভেন্দুর মধ্যে ওই ওয়ার্কিং অ্যাডজাস্টমেন্টটাই ছিল মাত্র।
শুভেন্দুর ঘনিষ্ঠদের মতে, এখন তো দাদার পক্ষে মর্যাদা নিয়ে দল করাও মুশকিল। কারণ, সাংগঠনিক পদ যাঁর যাই থাকুক না কেন, তৃণমূল দলটা দৈনন্দিন কার নির্দেশে চলে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই সঙ্গে জুটেছেন একজন পেশাদার। একটা রাজনৈতিক দল এ ধরনের ভাড়াটে পেশাদারের কথায় চলবে কেন? আর যাঁরা বিশ, ত্রিশ বছর ধরে রাজনীতি করছেন, তাঁরাই বা তাঁর কথা শুনে চলবেন কেন! এটা অবশ্যই মর্যাদার প্রশ্ন। এবং রাজনীতিতে মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে আপসের কোনও প্রশ্ন নেই।
শুভেন্দুর ঘনিষ্ঠরা যখন এমনই সব কথা বলে গিয়েছেন, তখন দেখা গেছে গত সাত দিন ধরে তৃণমূলের মুখপাত্ররা বলতে গেলে ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে গিয়েছেন। শুভেন্দুকে নিয়ে প্রশ্ন করলেই তাঁরা বলেছেন, শুভেন্দু অধিকারী দলের একজন বিশিষ্ট নেতা। তিনি দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কমিটির সদস্য এবং মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ দুটি দফতরের মন্ত্রী।
অর্থাৎ, দলে এবং সরকারে শুভেন্দুকে যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এবং তৃণমূলের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুভেন্দুর বড় ভূমিকা রয়েছে। এর পরেও শুভেন্দু দল ছাড়লে তখন বলা যাবে তৃণমূলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে।
সার্বিক এই পরিস্থিতিতে একটা বিষয় পরিষ্কার। শুভেন্দু হয়তো আর তৃণমূলে থাকবেন না। আগামী দিনে তাঁর রাজনৈতিক পথ কী হতে পারে তার ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে অনেকটাই। তবে আপাতত রাজ্য রাজনীতির এই তরুণ দাপুটে নেতা যে ভাবে এগোচ্ছেন, তাতে অনেকে মনে করছেন, বেশ পরিণত বুদ্ধির পরিচয় দিচ্ছেন তিনি।
একের পর এক অরাজনৈতিক সভা করে মাঠ ক্রমশই বড় করে চলেছেন। যে হেতু এখনও তৃণমূলে রয়েছেন, তাই দলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোনও নেতিবাচক কথা বলেননি। আবার মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিলেও দলের বিধায়ক পদ ছাড়েননি। ফলে তৃণমূলও অদ্ভূত সমস্যায় পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, খোলাখুলি কোনও মন্তব্য করতে পারছে না।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জমজমাট। পদত্যাগ ও দল ছাড়ার কারণ নিয়ে আগামী দিন শুভেন্দু নিজে পষ্টাপষ্টি কোনও কথা বলেন কিনা এখন সেটাই দেখার। আর অজয় মুখোপাধ্যায়ের মতো কোনও পুস্তিকা প্রকাশ করলে তো কথাই নেই।