
তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
“এটা আমার বা কারও একার অভিযান নয়। এটা আমার দেশের জন্য অভিযান। এটা সমস্ত পর্বতারোহণ জগতের জন্য একটা গর্বের অভিযান। … শীতে যত শৃঙ্গে সফল আরোহণ হয়েছে, কোনওটাতেই আমি কোনও শেরপার নাম দেখিনি কখনও। তাই এটা যেন আমাদের শক্তিকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর একটা সুযোগ। তাই আমরা শেরপারা, এই যে এত দেশ-বিদেশের অভিযাত্রীর আরোহণকে এত দিন ধরে সফল করেছি, সেই আমাদের জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জ, এটা একটা খুব খুব বড় কিছু।”
–মাসখানের আগে নেপাল ছাড়ার সময়ে এই কথাগুলো বলেছিলেন মিংমা গ্যালজেন শেরপা। শীতকালীন কেটু শৃঙ্গ অভিযানের এক জন সদস্য তথা দলনেতা ছিলেন তিনি। দিন কয়েক আগে, ১৬ জানুয়ারি ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়েছে তাঁদের সাফল্য। মিংমা তাঁর দলের আরও ৯ জন সদস্যের সঙ্গে জয়ের পতাকা উড়িয়েছেন বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতম শৃঙ্গের মাথায়। শীতকালে। এই প্রথম।
‘স্যাভেজ মাউন্টেন’ থেকে এল সুখবর
১৬ জানুয়ারি বিকেল ৫টায় সুখবর আসতেই হইহই পড়ে যায় বিশ্বজোড়া পর্বতারোহণ মহলে। আসলে বেশ কিছুদিন ধরেই এই আরোহণের দিকে তাকিয়ে ছিল অভিযাত্রী মহল। সোশ্যাল মিডিয়ায় তো বটেই, কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও চলছিল নিয়মিত চর্চা। হবে নাই বা কেন। বিশ্বের অন্যতম বা হয়তো কঠিনতম অভিযানের পণ ধরেছেন নেপালি আরোহীরা। প্রতিদিন একটা একটা করে ধাপ পার করেছেন চরম প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে। সে অভিযান পাখির চোখ হবে না!


তার ওপরে সে শৃঙ্গের নাম গডউইন অস্টিন। তথ্য বলছে, ৮৬১১ মিটার উঁচু এই শৃঙ্গে এখনও পর্যন্ত পা রাখতে পেরেছেন মাত্র ৩০৬ জন। যেখানে এভারেস্টের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ৬২০৮। কেটু অভিযানে এ যাবত মারা গিয়েছেন ৮১ জন আরোহী। প্রতি ১০০ জন আরোহীর মধ্যে ২৬.৪৭ জন মারা গেছেন এই কেটু-র কোলে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনা বাদ দিয়েও, দীর্ঘ সামিট পথের ক্লান্তিই সহ্য করতে পারেননি কত জন! তাই কেটু-কে পর্বতারোহীরা চেনেন ‘স্যাভেজ মাউন্টেন’ নামেও।
মৃত্যুর পরোয়ানা হাতে নিয়ে চলে আরোহণ
এইবারের অভিযানে, এ সব কিছুর ওপরে এই সময়টা ছিল শীতকাল। চরমতম প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গে লড়ে একটা করে পা ফেলার চ্যালেঞ্জ। এমনিতেই কেটু শৃঙ্গের আবহাওয়া পর্বতারোহী মহলের কাছে ত্রাস। তাঁরা বলেন, কখন যে কতটা খারাপ হবে পরিবেশ, কেউ বলতে পারে না। আচমকাই প্রবল হাওয়ায় সব তছনছ হয়ে যায়। পরিষ্কার আকাশের পরমুহূর্তেই এমন ঘন তুষারপাত হতে পারে, যে পথ খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। সেই সঙ্গে তুষারধসের আতঙ্ক তো আছেই। কিছু কিছু জায়গায় রকফলও হয় বিপজ্জনক ভাবে। এক মুহূর্তের ভুলে শেষ হয়ে যেতে পারে জীবন। হয়েওছে। এমন কিছু ঢাল আছে, যেখানে ফিক্সড রোপ থেকে নিজেকে খোলা মানেই মৃত্যুর পরোয়ানায় সই করা। কারণ পা পিছলে গেলে নিজেকে আটকানো অর্থাৎ ‘সেল্ফ অ্যারেস্ট’ কার্যত অসম্ভব।
শীতের চ্যালেঞ্জ
শীতকালীন অভিযান বিষয়টি অবশ্য পর্বতারোহণ জগতে নতুন বিষয় নয়। আসলে পর্বতারোহণ একটা দুর্দান্ত ও কঠিন বিষয় হলেও, এই কঠিনকে আরও বেশি কঠিন উপায়ে জয় করার চ্যালেঞ্জ মানুষ বারবারই নিয়েছে। এটাই হয়তো অভিযানের আনন্দ, এটাই হয়তো এক একটা আরোহণকে আলাদা মাত্রার করে তোলে। সেই কারণেই, দুর্গমতম যে শৃঙ্গকে আরোহণ মরসুমে ছুঁয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছে, তাকেই শীতকালের প্রতিকূল আবহাওয়ায় স্পর্শ করার অসম্ভব জেদ ধরে নতুন করে প্রস্তুতি নিয়েছেন অভিযাত্রীরা।
১৯৮০ সালে এভাবেই প্রথম শীতকালে সামিট হয় এভারেস্ট। এর পরে ১৯৮৩ সালে একটি পোলিশ টিম শীতকালীন অভিযান করে কেটু শৃঙ্গে। হয়নি সেবার, অধরা থেকে যায় চুড়ো। ৩৮ বছর পরে বদলে গেল ইতিহাস। অসম্ভবের অধ্যায় লিখলেন নেপালিরা। আরও নির্দিষ্ট করে বললে শেরপারা।
নির্মল পুর্জা যেন বিশ্বের বিস্ময়
দলের অন্যতম আর এক সদস্য ও লিডার নির্মল পুর্জা যদিও জাতিগত ভাবে শেরপা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নন, তবে পাহাড়ের দক্ষতা ও অসীম শক্তির দিক থেকে তিনিও কোনও অংশে কম নন। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসেই মাত্র সাত মাসের মধ্যে পৃথিবীর ১৪টা ৮০০০ মিটারের শৃঙ্গ ছুঁয়ে আরোহণ করার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন এই নির্মল পুর্জা। পর্বতারোহণ মহল তো বটেই, বিস্মিত করেছেন গোটা দুনিয়াকে। কেউ বলেছেন অতিমানবিক, কেউ বলেছেন অবিশ্বাস্য! কিন্তু সে যাই হোক না কেন, ব্রিটিশ আর্মির গোর্খা ব্রিগেডের রিটায়ার্ড অফিসার তথা নেপালের স্পিড ক্লাইম্বার নির্মল পুর্জা এমনই। তাঁর পক্ষে সবই ‘পসিবেল’।
বেসক্যাম্প থেকে হাইক্যাম্প
এই বছর শীতকালে চারটে দল, জনা চল্লিশ শেরপা ও প্রায় ৬০ জন আরোহীকে নিয়ে কেটু আরোহণ করার জন্য কেটু বেসক্যাম্পে হাজির হয়েছিল। জানুয়ারি মাসের ১২ তারিখে তিনটি টিমের ১০ জন নেপালি পর্বতারোহী বেস ক্যাম্প থেকে ওপরে উঠতে শুরু করেন শৃঙ্গের পথে। অন্য টিমের দুই আরোহী জন স্নরি সিগুরিয়নসন, মহম্মদ আলি সদপরা এবং তাঁর ছেলে সাজিদ আলি ক্যাম্প ওয়ান পর্যন্ত রোপ ফিক্স করে রেখেছিলেন আগেই। তাঁরা যদিও ক্যাম্প ওয়ানের পরে আর এগোতে পারেননি। তবে তাঁদের রোপে ক্যাম্প ওয়ান অবধি পৌঁছে, তার পরে ক্যাম্প ওয়ান থেকে টু-এর পথে রোপ ফিক্সড করেন মিংমা গ্যালজেন এবং নির্মল পুর্জা। বুধবার, ১৪ জানুয়ারি ক্যাম্প থ্রি পর্যন্ত পৌঁছে যায় ১০ জনের দলটি। এই দিন রোপ ফিক্স্ড করেন মিংমা গ্যালজেন। তার পরের দিনই, ১৫ তারিখ ক্যাম্প ফোরও মিংমার নেতৃত্বে অকুপাই হয় সফল ভাবে। এটি ‘হাই ক্যাম্প’ নামে পরিচিত। আরোহীরা পরে জানিয়েছেন, গোটা আরোহণ পথে, এই ক্যাম্পটুকুই কেবল সামান্য সমতল জায়গায় তৈরি করা সম্ভব। বাকি সব ক’টিই ঢালের মধ্যে বিপজ্জনক ভাবে স্থাপন করা হয়েছিল।
৭৩৫০ মিটার উঁচু হাই ক্যাম্পে সে রাতে হাওয়ার গতিবেগ ছিল ৪০ থেকে ১০০ মিটার প্রতি ঘণ্টায়। যতটা প্রতিকূলতার আশঙ্কা থাকে, সে তুলনায় কমই বলা যায়। তবে শনিবারের পর থেকেই আবহাওয়া খারাপ হওয়ার পূর্বাভাস ছিল। যদিও পূর্বাভাস মেনেই যে আবহাওয়া খারাপ হয় এ অভিযানে তা নয়, তবুও আরোহীদের আগাম প্ল্যানিং সেই বুঝেই হয়। ফলে সরাসরি বলতে গেলে, শনিবারটাই হাতে ছিল, সম্ভাব্য শৃঙ্গ আরোহণের বা সামিটের দিন হিসেবে।
ডেথ জোনে সারারাত, সারাদিন
তাই পরের দিন, শুক্রবারই রাত একটা নাগাদ নির্মল পুর্জার নেতৃত্বে শৃঙ্গের দিকে দলবদ্ধভাবে এগিয়ে যান দশ তুখোড় আরোহী। নির্মল ছাড়া বাকিরা হলেন গ্যালজেন শেরপা, মিংমা ডেভিড শেরপা, মিংমা গ্যালজেন, সোনা শেরপা, মিংমা তেনজি শেরপা, পেম ছিরি শেরপা, দাওয়া টেম্বা শেরপা, কিলু পেম্বা শেরপা ও দাওয়া তেনজিং শেরপা। তাপমাত্রা যে মাইনাসের অনেকটাই নীচে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি মেপে ‘উইনডো’ বুঝে সামিটের দিন ঠিক করলেও, সকলেই জানেন কেটু-র বুকে কতটা অঘটন ঘটিয়েছে প্রকৃতির রোষ।
এসব ঝুঁকির মধ্যে দিয়েই আট হাজার মিটারের ওপরে রাত ভর এক এক করে এগোতে থাকে দশ জোড়া স্নোবুট-পরা অদম্য পা। এগোতে থাকে সবটুকু শক্তি, সাহস, স্বপ্ন। বরফের ওপরে জেদি ক্র্যাম্পনের কাঁটা একটু একটু করে আঁকতে থাকে শৃঙ্গ ছোঁয়ার পথ।
অদম্য ক্র্যাম্পন তুষারে লিখল ইতিহাস
সবকিছুর উপরে যে কোনও পর্বতারোহী মাত্রেই জানবেন, ওই তুমুল উচ্চতায় শারীরিক ও মানসিক ভাবে ঠিক কতটা জোর লাগে, উচ্চতা ভাঙতে। এই উচ্চতাকে বলাই হয় ‘ডেথ জোন’। এত কম অক্সিজেনে, দুরূহ পরিবেশে বেশিক্ষণ থাকাটাই জীবনের জন্য বিপজ্জনক। সেখানে গোটা রাতের পরে সারা দিন এগিয়ে যান আরোহীরা। বিকেল পেরিয়ে যায় প্রায়, তখন পৌঁছনো যায় ‘বটল নেক’-এ। এই বটল নেকই হল কেটু অভিযানের কঠিনতম অংশ। ভীষণ সরু এক ফাঁক দিয়ে, অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে ইঞ্চি-ইঞ্চি মেপে উঠতে হয় চুড়োর দিকে।
এক সময়ে শৃঙ্গের ঠিক তিরিশ ফুট নীচে একটি জায়গায় পৌঁছন প্রথম আরোহী। আগে থেকেই ঠিক ছিল, এ জায়গাটিতে প্রত্যেকে বাকিদের জন্য অপেক্ষা করবেন। ১০ জন একজায়গায় এসে গেলে তবেই তাঁরা একসঙ্গে শৃঙ্গে আরোহণ করবেন। শনিবার, ১৬ তারিখ বিকেল চারটে নাগাদ খবর আসে ওই নির্দিষ্ট জায়গাটিতে পৌঁছে গেছেন তাঁরা। সকলে নিরাপদে ও সুস্থ আছেন।
শৃঙ্গ’জয়’ নয়, তবু বিজয়ী তাঁরাই
পর্বতারোহী মহল তখনই একরকম ধরে নিয়েছিল, ইতিহাস লেখা হয়ে গেছে। তবু দাঁতে-দাঁত চেপে নিশ্চিত খবরের অপেক্ষা। কারণ পাহাড়ে কখন কী হয়, তা কেবল পাহাড়ই তো জানে! সত্যি বলতে আরোহণ নিশ্চিত হওয়ার পরেও যে অনেকের বুক ধুকপুক কমেনি, এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ তথ্য ও অভিজ্ঞতা দুইই বলছে, পর্বতাভিযানে বেশিরভাগ দুর্ঘটনা অবতরণের সময়েই ঘটে। শরীর যখন ক্লান্ততম, মন যখন অবসন্ন, তখন সামান্য বিপদও অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলে।
সব আশঙ্কাকে মিথ্যে করে, সফল সামিটের খবর আসে। তার পরে নিরাপদে ক্যাম্পে নেমেও আসেন বিজয়ীরা। না, পাহাড়কে জয় করা যায় না। ‘শৃঙ্গজয়’ কথাটা বলতে বা লিখতেও অস্বস্তি বোধ করেন বহু পর্বতপ্রেমীই। তবু এই সফল অভিযানে, তাঁরা বিজয়ী। শৃঙ্গকে জয় করে নয়, গোটা মনুষ্যপ্রজাতির হয়ে শক্তির, সাহসের, দক্ষতার এক চরমতম পরীক্ষায় তাঁরা বিজয়ী।
রেখেছো শেরপা করে, আরোহী করোনি
আসলে, শেরপা শব্দটার সঙ্গে যেন জড়িয়ে আছে, রুটি-রুজির দায়ে পাহাড় চড়তে আর চড়াতে যাওয়ার ধারণাটুকু। শুধু তাই নয়, বছর-বছর পেটের দায়ে অভিযানে গিয়ে মৃত্যু যেন বাই-প্রোডাক্ট তাঁদের কাছে। মৃত্যুর পরেও আরোহণ ইতিহাসে ট্র্যাজিক হিরো ছাড়া অন্য পরিচয় জোটে না। এমনকী আরোহী হিসেবেও সেভাবে জোটে না খ্যাতির মুকুট। আজও তাই এডমন্ড হিলারির পরেই করা হয় তেনজিং নোরগের নাম।
অথচ, পৃথিবীর কোন কোন প্রান্ত থেকে একের পর এক পর্বতারোহী দল নিরন্তর ছুটে আসে হিমালয়ে, এই শেরপাদের ভরসাতেই। কিন্তু ‘অভিজাত’ আরোহী মহল এখনও শেরপাদের সহ-অভিযাত্রীর চোখে দেখতে শেখেনি অনেক ক্ষেত্রেই। তাঁরা উচ্চতার সঙ্গী, বিপদের উদ্ধারকর্তা। জিনগত ভাবে রক্তে অতিরিক্ত লোহিত কণিকা থাকায় যাঁদের শরীরে অক্সিজেন বেশি প্রবাহিত হয়। পাহাড় চড়াটা যাঁদের কাছে সহজতর। পয়সার বিনিময়ে যাঁদের সঙ্গে নিয়ে, যাঁদের দিয়ে মালপত্র বইয়ে, প্রয়োজনে যাঁদের পিঠে চড়েও উঁচু থেকে আরও উঁচু শৃঙ্গ জয় করে ফেলা যায়।– এটুকুই।
এবার যেন এ সবকিছু ওলোটপালোট হয়ে গেল। ১০ জন নেপালি আরোহী যেন দেখিয়ে দিলেন, পর্বতারোহণের কঠিনতম বাজিটা আজও তাঁরাই জিতেছেন। তাবড় পর্বতারোহীরা যা করে দেখাতে পারেনি এত বছর ধরে, তাই করে দেখিয়েছেন তাঁরা। তাঁরা ইতিহাসের পাতায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন উজ্জ্বলতম অক্ষরে। যে অক্ষর শিখতে হয়তো এখনও বহু চড়াই-উতরাই পেরোতে হবে পর্বতারোহণ মহলকে।