
অ্যাসিড-মুক্ত নারী দিবস কবে আসবে?
কিন্তু আমি সেই মানুষগুলোকে কোন কাঠগড়ায় দাঁড় করাব, যাঁরা একটা অ্যাসিডে পোড়া মেয়ের দিকে প্রতিনিয়ত আঙুল তুলে বলে গেছে, "এত বাড় বাড়লে এমনই হয়।"
মনীষা পৈলান
এত অবধি শুনে বোধহয় খানিকটা ‘বিশেষ বিশেষ খবর পড়ছি’ বলে মনে হল। আসলে এটা খবরই, যে খবর সকলে জানেন। বহু বহু বহু বার বলে বলে আমি ক্লান্ত। কিন্তু সে ক্লান্তি কখনও প্রকাশ করি না আমি। কারণ আমি জানি, এটা আমায় বলে যেতে হবে লড়াইয়ের শেষ দিন পর্যন্ত।
কিন্তু আমায় আরও কিছু বলে যেতে হবে। এই ঘটনার বাইরেও আরও অনেকটা বলার আছে আমার। আজ, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে যখন সুযোগ মিলেছে, তখন বলে ফেলতে চাই।
আমি বলতে চাই, ওই অ্যাসিড হামলার আগে পর্যন্ত কিন্তু প্রতি মুহূর্তে প্রত্যাখ্যান করে এসেছি সেলিমকে। এবং কাউকে বোঝাতে পারিনি, সে আমার প্রেমিক নয়। সে একজন ক্রিমিনাল, যে আমায় প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দিয়ে আসছে। কেউ শোনেনি আমার কথা। বরং ওর ওই ধরনের আচরণ অনেকের কাছেই ‘প্রেমে পাগল হয়ে যাওয়া’ ছিল।

আমার মনে হয়… না আমার শুধু মনে হয় না। আসলে এই পোড়া শরীরের মাসুল দিয়ে আমি যেটা শিখেছি, সেটা হল নারীবাদের প্রথম ধাপ এই প্রেম আর অপরাধের পার্থক্য করতে পারা। অ্যাসিড ছেড়ে দিলাম, শুরু করা যাক সঙ্গীর গায়ে হাত তোলা দিয়েই। না। এটা ভালবাসা নয়। মারা, গায়ের জোরে শরীরি অধিকার চাপানো, আবেগপ্রবণ হুমকি– এগুলো কোনওটাই ভালবাসা নয়। এটা আমাদের আগে বিশ্বাস করতে হবে, মাথায় ঢুকিয়ে নিতে হবে। তা আমার নিজের ক্ষেত্রে হোক বা প্রতিবেশী কোনও মহিলার ক্ষেত্রে। ভালবাসা আর অ্যাবিউজ়িং এক নয়। আমি কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অ্যাবিউজ়ড হয়ে এসে তার পরে অ্যাসিডের মুখে পড়েছি। তাই কোনও কিছুকেই আমরা যেন হালকা করে না দেখি।
‘প্রেমিকের’ অপরাধ না হয় আজ স্পষ্ট। কিন্তু আমি সেই মানুষগুলোকে কোন কাঠগড়ায় দাঁড় করাব, যাঁরা একটা অ্যাসিডে পোড়া মেয়ের দিকে প্রতিনিয়ত আঙুল তুলে বলে গেছে, “এত বাড় বাড়লে এমনই হয়।” আমি তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি, আমি বাড় বেড়েছিলাম। মুসলিম পরিবারের মেয়ে হয়েও আমি পর্দা করতাম না। আমি চাকরি করতাম। আমি সাজতে ভালবাসতাম। আমি জিন্স পরতাম। আমি টিভিতে গান চালিয়ে নাচতাম। আমি ধরেই নিচ্ছি, আমি খুউউউব বাড় বেড়েছিলাম। তার শাস্তি হিসেবে বুঝি অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত? এটা ভাববেন না, এমনটা আমি একা শুনেছি। আপনি যে কোনও মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত সমাজের ধর্ষিতা বা অ্যাসিডে পোড়া বা নির্যাতিত মেয়ের সঙ্গে কথা বলে দেখুন, প্রত্যেকে কোনও না কোনও ভাবে ‘বাড় বাড়ার’ শাস্তি পেয়ে চলেছে, এক শ্রেণির মানুষের চোখে।
ফলে এটা নিশ্চয় অ্যাসিড আক্রান্ত হওয়ার যুক্তি হতে পারে না! যদি হতে না পারে, তাহলে মেয়েটির দিকে আঙুল না তুলে, সব ক’টি আঙুল অপরাধীর দিকে ঘোরানো থাক। এইটুকু কি করতে পারে আমাদের সমাজ?
না, পারে না। আমি নিশ্চিত করে বলছি, পারে না। পারলে, আজও আমি যখন গ্রামে ফিরি, তখন আমায় দেখতে হতো না, জামিনে মুক্তি পেয়ে, বিয়ে করে, বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেলিম, সারা গ্রাম ওকে ঠিক আগের মতোই দেখছে, আর আমায় দেখছে হয় বাঁকা চোখে নাহয় সহানুভূতির চোখে।
লড়াই আমার নতুন নয়। নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েরা বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখলে, সে স্বপ্ন পূরণ করতে লড়াই ছাড়া অন্য পথ থাকে না। আমি লড়েছি বহু দিন আগে থেকে। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে হয়ে, ফিটফাট পোশাক পরে ঘরের বাইরে পা রাখা থেকেই আমার লড়াই শুরু হয়েছিল। বিউটিশিয়ান কোর্স থেকে কম্পিউটার ট্রেনিং, কী না করেছি! কত না পরিশ্রম করেছি! করতে করতে, লড়তে লড়তে আমার বড় হওয়ার স্বপ্ন যখন পূরণ হওয়ার মুখে, একটা ভাল চাকরি যখন প্রায় হাতের মুঠোয়, তখনই এই অ্যাসিড হামলা।
রাতারাতি বদলে গেছিল সব। সে ধাক্কার কথা নতুন করে আর বলছি না। সে ব্যথা, সে কষ্ট, সে যন্ত্রণা শতশব্দেও প্রকাশ করতে পারি না আমি আর। বরং এত বড় বিপদের পরেও ইতিবাচক কী ঘটতে পারে একটা মেয়ের জীবনে, সে কথা বলি। আমি ঘটনার পরে বেরিয়ে আসি বাড়ি থেকে। গ্রাম ছেড়ে দিই। কিছু সংগঠন, কিছু মানুষ– সবসময় পাশে ছিল। আমি তাঁদেরই ভরসায় নতুন করে শুরু করি পড়াশোনা। শুরু করি লেখালেখি। প্রথম মাধ্যম ফেসবুকই। এই ফেসবুক অ্যালবামেই সাজানো ছিল আমার সুন্দর সুন্দর ছবি। সে ছবিগুলো পার করে, সামনে আনলাম পোড়া, বীভৎস মুখটা। সবাইকে জানিয়ে দিলাম, মুখ আমি ঢাকব না।
কেন ঢাকব বলুন তো? ততদিনে দু’বছর পেরিয়েছে, আর অপরাধীরা ধরা পড়ে জামিনও পেয়ে গেছে। বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাড়া। মূল অপরাধী তখন আমার গ্রামের চোখে রীতিমতো ট্র্যাজিক হিরো, যে প্রেমে দাগা খেয়ে উন্মত্তের মতো অ্যাসিড ছুড়ে ফেলেছে! হ্যাঁ, ছুড়ে মেরেছে নয়, ‘ছুড়ে ফেলেছে।’ একটা আস্ত ক্রিমিনাল যদি এভাবে বাঁচতে পারে, আমি কেন মুখ লুকিয়ে বাঁচব? ঠিক কোন যুক্তিতে? বাড় তো নাকি আমি আগেই বেড়েছিলাম। এখন আমার আর হারানোর কী আছে? মরে যেতে হবে বড় জোর! তাই যাব। তবু মুখ ঢাকব না।
প্রশংসার বন্যা বয়ে গেছে। আমার সাহসের কথা কত জন কত ভাবে বলেছেন। এই যে আজ নারী দিবস, আমি নিজের অজান্তেই কত মানুষের শক্তি। কিন্তু এ শক্তির স্বীকৃতি আমায় যতটা অনুপ্রাণিত করে, ঠিক ততটাই হতাশ করে বিচারের প্রহসন। একটা আস্ত অপরাধীর ছাড়া পেয়ে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য আমায় প্রতিটা মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয়, শত বাহবার পরেও আমি পরাজিত। আমি আসল জায়গাটায় হেরে গেছি। সমাজ আমায় আগেই হারিয়েছিল, আইন আমায় এখন হারিয়ে দিচ্ছে রোজ। এ হারের জ্বালা অ্যাসিডের চেয়ে অনেক অনেক অনেক বেশি।
এখন আমি ভাল আছি। পড়াশোনা, নাচ, গান, লেখালেখি, টুকটাক কাজ– সব আছে আমার। একেবারে স্বাভাবিক। আমি চামড়ার ঊর্ধ্বে উঠে বাঁচতে শিখে গেছি। পাশাপাশি, আমি দল বাঁধতেও শিখে গেছি। আমি তো একা নই। আমার মতো কত কত মনীষা চারপাশে। প্রত্যেকের একদিকে যেমন নিজেদের আইনি লড়াই , অন্যদিকে চিকিৎসার লড়াই। সামাজিক লড়াই তো রয়েইছে। সেই সঙ্গে দলবেঁধে আরও একটা লড়াইয়ে ঝাঁপিয়েছি আমরা। খোলা বাজারে অ্যাসিড বিক্রি হওয়া কী করে বন্ধ করা যায়, তাই নিয়ে লড়ছি আমরা। স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পথসভা করছি সচেতনতা বাড়াতে।
নারী দিবস তো আরও একটা পেরিয়ে গেল। আরও অনেক অনেক নারীর সাফল্য আমরা জেনে ফেললাম। আমি আরও একবার সুযোগ পেলাম চিৎকার করে কথাগুলো বলার। কিন্তু তার পরে? এই দিবস পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কি আমার চিৎকারটুকুর রেশ রয়ে যাবে কোথাও? নাকি আমরা অপেক্ষা করব, পরের বছরে আরও নতুন কয়েক জন অ্যাসিড আক্রান্তের খবর পাব বলে?