
সৃজা ঘোষ

যবে থেকে প্রাণ পৃথিবীতে এসেছে, রাজনীতির সূত্রপাত ঠিক তবে থেকেই। তার পর থেকে আজ অবধি এই স্বাভাবিক রাজনীতিতে যে শব্দটি নিদারুণ কালো ছায়া ফেলে দিল, তাকে অসহিষ্ণুতা বলে। আর এ রোগের প্রকোপ বাড়তে বাড়তে আজকের মানুষ এত উন্মাদ, যে সে রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে আর এক মারাত্মক জীবাণুকে, যার নাম ধর্ম। আর সে ধর্মের তীব্র মাথাব্যথায় মধ্যমণি হিসেবে খাড়া করে দাঁড় করানো হয়েছে যে ঈশ্বরকে, তার অস্তিত্বের কথা, তার আপন ধর্মের কথা, তার ইচ্ছের খোঁজ রাখেনি এই মাতব্বর রাজনীতিবিদদের একটি অংশও।

যাঁরা এত দূর এসে ভাবছেন আমি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে অপমানের অভিপ্রায়ে এ লেখাটি লিখছি, অথবা যাঁরা বুঝতে পারছেন না আজকের মতো নরম রবির সকালে এমন প্রসঙ্গ উত্থাপনের কারণ, তাদের উদ্দেশ্যে বলার– এই গোটা লেখাটায় আজ বরং পাঠক এবং লেখক মিলে বুঝতে চেষ্টা করি, আমাদের অন্যতম এক ভীষণ নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থল রবীন্দ্রনাথের লেখার মধ্যে কী ভাবে, কোন ইচ্ছায় কোন ঈশ্বরকে আমরা খুঁজে পাই। তাঁকে পড়ে ধর্মের কোন রঙ স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের মননে?
রবীন্দ্রনাথ পড়ে আমি বুঝেছি, ঈশ্বর আমার-আপনার থেকে খুব বেশি দূরে বসবাসকারী কোনো অপার্থিব অলৌকিক নয়। সে আপন। তার বাস আমারই নিভৃতে। তার সঙ্গে আমাদের প্রত্যেকের সখ্য যেমন আছে, তেমন বিরোধও আছে, তার দায়ে যেমন আমায় দায়িত্ব, তেমনই আমার দায়েও তার দায়িত্ব। সে শুধুই স্থির নয়, আমার মতোই পরিবর্তনশীল। আমি আছি, তাই সে আছে। আমার ওপরে ঈশ্বর নয়, আমার পাশে তার ঠাঁই। তাই তার সাথে চলাটুকুই বন্ধুত্বের চলা।

রবীন্দ্রনাথ লিখছেন- “তোমার বীণা আমার মনমাঝে/ কখনও শুনি, কখনও ভুলি, কখনও শুনি না যে,” ঈশ্বর এমনই সহজ অনুভূত হয় তার লেখায়, অথচ আমরা দিনে দিনে কোন রাজনীতিতে সেই সহজকে এমন বিষম করে তুললাম, তার হিসেব পাই না। আর যারা এই নোংরা রাজনীতির হত্তাকত্তাবিধাতা, যাঁরা আমাদের পাঠকদের মতো করে অনুভবই করলেন না কিচ্ছুটি, যারা শুধু বলেই চললেন, চিৎকার করে, হাউমাউ করে, এ ওর গলা টিপে ধরে তারস্বরে বলেই চললেন, তাঁদের হয়ে বোধ হয় কবি ঈশ্বরকে বললেন–
“যারা কথা দিয়ে তোমার কথা বলে,
তারা কথার বেড়া গাঁথে কেবল দলের পরে দলে।
একের পরে আরে
বুঝতে নাহি পারে
বোঝাই যত কথার বোঝা ততই বেড়ে চলে।”
যেমন বোঝা বেড়ে চলেছে আমাদের। অথচ ধর্ম পালন করতে গেলে, ঈশ্বরের সঠিক মূল্য তাকে দিতে হলে, সত্যি তাকে বুঝতে হলে, আমাদের কেবল আপন কাজটুকুই নিষ্ঠা নিয়ে করলে চলত। এ আমার কথা নয়, কবি লিখছেন- ‘গানের ভেতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি/ তখন তারে চিনি আমি, তখন তারে জানি।’
এ জানা তো শুধু তাকে জানা নয়, এ জানা আত্ম অনুসন্ধান। নিজেকে জানি না বলেই আমরা এত হানাহানি করি, নিজেকে বুঝি না বলেই আমাদের এত ক্রোধ, নিজেকে দেখি না বলেই আমাদের এত অসহিষ্ণুতা। আমরা শুরুতেই নিজেদের বৃহৎ দেখিয়ে, আদতে আত্মকে ক্ষুদ্র করে বসে আছি, আমাদের সম্ভাবনার হদিস আমরা পাইনি, নিজেদের যত্ন নিইনি, নিজেদের মানুষ করিনি। শুধু চেঁচিয়েছি ধর্ম ধর্ম করে।
আর অতগুলো দিন আগে, রবীন্দ্রনাথ কত সহজে বলে দিয়েছিলেন– ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।/এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।/ কত জনম-মরণেতে তোমারি ঐ চরণেতে/ আপনাকে যে দেব তবু রইবে দেনা।’ আর আমরা… দেওয়ার আগেই পাওয়ার আশায় মেতেছি।
অথচ আলো ছিল, ভালো ছিল। বিবাদের মধ্যেও আমরা একটা সত্যের খোঁজ পেতে পারতাম। কিন্তু আমাদের পেতে দেওয়া হল না। কারণ সমাজে-সংসারে-দেশে-পৃথিবীতে যারা ধর্ম আর ঈশ্বর নিয়ে রাজনীতি করছেন, তাদের মান্যতা দিয়েছি আমরাই। আমরা ভুলে গেছি সেই এক চূড়ান্ত ভালোকে, চূড়ান্ত আলোকে, চূড়ান্ত পথকে– যার সঙ্গে বিরোধ থাকলেও যাকে ছাড়া মানুষের ভিতরঘর নিঃস্ব– ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো, সেই তো তোমার আলো/ সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো, সেই তো তোমার ভালো!’
এই বাক্যগুলো পৃথিবীতে জন্মানোর পরেও, আজও পৃথিবী দ্বন্দ্বের আসল আনন্দ শিখল না। সে ভাবল কাটাকাটিতেই সুখ, হানাহানিতেই সাফল্য। তাই একটা দেশ আর একটা দেশের ওপর বোমা ফেললে, আর একটা দেশের মানুষ অন্য দেশটাকে গুঁড়িয়ে দেবার স্বপ্ন দেখে। তাই প্রেমের প্রস্তাব গ্রহণ করল না বলে একটা মানুষের দিকে অ্যাসিড ছুড়ে দেওয়ার ভাবনা মাথায় আসে। দিনের পর দিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে কিছু কেউকেটা মানুষ শুধু দেখিয়ে দেওয়ার কথা বলে, এরা এত অন্ধ এরা নিজেদের দেখতে পায় না। এরা সকলেই অচলায়তনের বাসিন্দা। এরা বোঝে না–
‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই, মরতে হবে।
পথ জুড়ে কী করবি বড়াই, সরতে হবে।।
লুঠ-করা ধন জড়ো করেকে হতে চায়া সবার বড়ো-
এক নিমেষে পথের ধূলায় পড়তে হবে।
নাড়া দিতে গিয়ে তোমায় নড়তে হবে। ‘
সবই বলে গেছেন। বলা হয়ে৷ গেছে সব। আমরাই ভয় পাই। খুঁজে মরি। অথচ নির্ভয়ে সেই সহজ নিভৃত প্রাণের দেবতাকে রবীন্দ্রনাথ চিনে নিতে পারেন, চিনিয়ে দিতে পারেন–
‘ওদের কথায় ধাঁধা লাগে, তোমার কথা আমি বুঝি,
তোমার আকাশ তোমার বাতাস এই তো সবই সোজাসুজি’…